খণ্ডযুদ্ধ: প্রতি দিন রাজ্যের কোথাও না কোথাও মারামারি এখন রুটিন। বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, আসানসোল, ৫ জুলাই। পিটিআই
হাউ ইজ় দ্য জোশ?’-এর বদলে ‘হাউ ইজ় দ্য দোষ?’ জিজ্ঞেস করলে, খিঁচিয়ে উঠুন। দোষ কিসের? চতুর্দিকে প্রচুর লোককে পিটিয়ে মারা হলে, দেশের জনসংখ্যা হুড়হুড় কমবে। রাস্তাঘাট তকতকে, জিডিপি উচ্চে, অপ্রহৃত জনতা প্রসন্নতায় মুখ ধুচ্ছে। তা ছাড়া, কোটি কোটি পাবলিক মোবাইলে মুণ্ডু সেঁধিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, একটা তীব্র শারীরিক কসরতে সব্বাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে, সমাজের স্বাস্থ্যটা টকটকে হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড়, এটি নিরাপদ স্পোর্ট। ফুটবল খেললেও শিনবোন মচকে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু অনেকে মিলে একটা লোককে পেটানোর মজা হল, সে প্রতিরোধ করতে পারে না, শুধু হাঁউমাউ কাঁদে আর ছটফটিয়ে ছাড়ান চায়, ফলে আপনার প্রত্যাঘাতের ভয় থাকে না। নিশ্চিন্ত ঘুসি, নিরুদ্বেগ লাথি। কিন্তু প্রথম প্রশ্ন, কাকে পেটাবেন। বেছে নিন একলা, গরিব, পাগলাটে দেখতে লোক। এদের সকলেই চোর-ছ্যাঁচড় ভাবে। আপনার টার্গেটকে জলদি ল্যাম্পপোস্টে পিছমোড়া বেঁধে ফেলার সময়, চলতি গাড়ি-সওয়ার বা পথচারী যেন দেখে পেত্যয় যায়, অঃ, এটা তো নির্ঘাত ক্রিমিনাল। বা পাতাখোর। নিদেন তারকাটা। কিন্তু সভ্যতার বৃহৎ গ্যাঁড়াকল, কার্যের পিছনে কারণ দেখাতে হয়। ‘মারতে ভাল লেগেছে, তাই মেরেছি’ কাঁচা সত্য গ্রহণ করার ধক এ মিনমিনে সমাজব্যবস্থার নেই। ফলে চিৎকার করে নালিশ-ভিত্তি গড়তে হবে। ‘মোবাইল চোওওর!’ বা ‘ছেলেধরাআআ!’ কিন্তু সেগুলো একটু ছিঁচকে, এই মুহূর্তে হিট নয়। ‘কাটমানি খাচ্ছেএএ’ খুব ভাল, আরও ভাল ‘অমর্ত্য সেনের বাড়ি যাচ্ছেএএ’, কিন্তু সর্বাধিক চলছে: ‘জয় শ্রীরাম বলছে নাআআা!’
এমনিতে মুসলিম মাত্রেই দেশের শত্রু, পাকিস্তানের লোক। হেথা বসে অন্ন ধ্বংসায়, ইন্ডিয়া হারলে জয়-লাফায়। এদের বাড়তে দিলে ক’দিন পরেই ভারত ইসলামি রাষ্ট্র, সুতরাং সময় থাকতে আপনিই হানুন ঘচাং-ফু। প্রাথমিক ভয় দুটো। পাড়া থেকে কোন দিগ্গজ সহসা গজিয়ে বলবে, সহিষ্ণুতা প্র্যাকটিস করুন। আর দুই, পুলিশ এসে পড়বে। কিন্তু পুলিশের এখন হাই উঠছে, ডাকতে গেলেই সে বলে, ‘ও সব আমাদের থানার আন্ডারে নয়, পঁচাশি মাইল দূরে চৌকিতে যান।’ আর পাড়ার আঁতেল? সে ব্যাটাকে বরং বাড়ির গ্রিলে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে দিন। ঠাটিয়ে কানের গোড়ায় থাবড়া, সঙ্গে ঝিংচ্যাক গালাগাল, ‘লিবটার্ড’, ‘সিকুলার’, ‘আর্বান নকশাল’! প্লাস তালি মেরে: ‘জপো প্রেমসে ব্রহ্মা-বিষ্ণু/ গরব সে বোলো হম অসহিষ্ণু!’ কেউ বখেড়া পাকাবে না, কারণ সব্বাই জানে এই বুদ্ধি-বলকানো আইটেমগুলোই সবচেয়ে বেইমান। শুধু নতুনত্বের স্টিকারওয়ালা বাতেলা বা চমকদার নিবন্ধ ঝাড়ার টিআরপি-লোভে এরা দেশ-মা’কে নড়া ধরে নর্দমায় চুবিয়ে দিতে পারে। জোড়া-ট্রেটর পেটাবার সুযোগ কেহ ছাড়ে না, ‘কিল ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’ রোজ উপলব্ধ নয়। ক’জন মিলে মার শুরু করুন, দেখতে দেখতে ভিড় জমে যাবে। অন্তরে সব্বাই ধর্ষকামী, সব্বার উগরে দেওয়ার কিলো কিলো ঝাল মজুত, লাজুকরা নয় এট্টু পরে জয়েন করবে। সাধে কি প্রখ্যাত সায়েব লিখেছেন: ‘সেমিফাইনালে গো-হার? চালাও গণপ্রহার!’
এমনিতে ন্যায় প্রতিষ্ঠিতে বেধড়ক ঠ্যাঙানির ঐতিহ্য আমাদের আছে। পেশেন্ট মারা গেলে রোগীর পরিজন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রকাণ্ড পেটান, জুনিয়র ডাক্তাররাও রোগীর পরিজনদের ফিরতি পেটান। উকিলদেরও পেটানো হয়েছে। অটো-চালকদের সঙ্গে যাত্রীদের শারীরিক কলহ হরদম। বাসের ড্রাইভার-কন্ডাক্টরকে হিড়হিড় টেনে নামানোর দৃশ্য বিরল নয়। মাতাল পেটানো আবশ্যিক সমাজসংস্কার, পকেটমার পেটানোও। পুলিশরা তো রোজ পাটকেল খাচ্ছেন, সেটাকে নিতান্ত সদর্থক বিপ্লব ধরে নেওয়া হয়। পুলিশরাও পেটান, কিন্তু তার গ্লোরি কম। শিক্ষকেরা মাঝে মাঝে মার খান। সাংবাদিক মারা এখন ‘কায়েমি স্বার্থের প্রতিরোধ’ হিসেবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পাচ্ছে। যাঁরা জমি জরিপ করতে যান, হুকিং-এর তার কাটতে যান, অনাদায়ী ঋণ আদায় করতে যান, তাঁদের মার বাঁধা। তাই মার দেখলে এ লাবণ্য-অঞ্চলে কেউ আচাভুয়া ক্রিয়া ভেবে থমকাবে না। কিন্তু জয় শ্রীরাম ছাপ্পা ধোলাইয়ের এস্পেশাল সোয়াদ হল: এটা নিছক ইসুভিত্তিক হিংস্রতা নয়। দেশের কাজ। ধর্মের কাজ।
ধর্ম চিরকাল বলেছে, মারো! দেশ চিরকাল বলেছে, মারো! ক্ষিপ্ত দৃপ্ত প্রতিশোধলিপ্ত আঘাতমুষ্টির প্রান্তে এই মহান দুই স্রোত এসে মিলেছে। যুগে যুগে এই দেশে ধর্মের অজুহাতে নিরীহ লোককে থেঁতলানো হয়েছে, অপমান করা হয়েছে, খুন করা হয়েছে। ধর্ম শেখায়, যে তোমার ধর্মের নয়, সে মানুষ নয়, তাকে মারা ভাল। দেশপ্রেম শেখায়, যে তোমার দেশের নয়, সে মানুষ নয়, তাকে মারা ভাল। ধর্ম বলে, উচ্চণ্ড জোরে মাইক বাজাব, লোকের ডিসটার্ব হোক। রাস্তা আটকে উপাসনা করব, জ্যাম হোক। মারপিট করব, তাতে আমার ধর্মের পতাকা শনশন। দেশপ্রেম বলে, জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে না দাঁড়ালে সিনেমা হল-এই বেধড়ক ঝাড়ব, উল্টো দিকের যুক্তি দিতে এলেই দেশদ্রোহী বলে জেলে ভরব, অন্য দেশের আতুর আশ্রয়হীন লোক এলে লাত্থি মেরে তাড়াব, শত্রু-দেশের মানুষ খুন করে সংখ্যা গুনে মজা লুটব যেন ফুটবলের স্কোর। আর আপনি যখন ‘দেশধর্মপ্রেম’ কম্বো-আবেগে লগুড় হানছেন, ডবল ওথলানি উদ্যাপন করতে, একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। মার চলাকালীন দর্শকদের বাইট দিন, লোকটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, প্লাস্টিক থেকে কী সব লাল লাল পড়ছে, আপনি জিজ্ঞেস করতে আড়ে তাকিয়ে বলল টমেটো সস, কিন্তু আপনি খাবলে নিয়ে দেখেন, অ্যাঁ, বিফ! ও দিকে আপনি তো পড়েছেন বিদ্যাসাগরের লেখা সহজ পাঠ, সেই পবিত্র গ্রন্থে লেখা: ‘ও ঔ/ কক্ষনও খাবে না গৌ!’ এবং ‘রেগে বলে ব্রুস ৯/ কেন হলি মুসলিম!’
হ্যাঁ, হতেই পারে, মারটা আপনার এখনও অতটা ধাতে আসেনি। তা বলে বসে থাকলে তো চলবে না, দেশ বাঁচাতে হবে, সেনাবাহিনীর ‘বি’-টিমে যোগ দিতে হবে। কয়েক জন আইকন চিহ্নিত করুন, তাঁদের মূর্তি থাকলে ভাঙুন, না থাকলে ছবিতে কালি লেপে প্র্যাকটিস করুন। এতে কিছুটা পণ্ডিতিও ফলানো গেল (মনীষীদের পুনর্মূল্যায়ন), নকশাল আন্দোলনের আঁচ পোয়ানোও হল (মহিমময় ও জরুরি-কালাপাহাড়ি হিংসা)। রবীন্দ্রনাথ যে জাতীয়তাবাদকে যাচ্ছেতাই করেছিলেন তা এখন সুবিদিত, তাঁর বক্তৃতাগুলো পিস পিস করে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ান (বেশি পড়ার ধৈর্য কার?), তাঁর নামে যত সদন হাসপাতাল মিষ্টান্নভাণ্ডার আছে, ভাঙচুর চালান। রবীন্দ্র সেতুকে কিছু করতে যাবেন না, মাঝেরহাট-টার দায় আপনার ঘাড়ে এসে পড়বে। মাইকেল মধুসূদনকে গালাগাল দিন। রাবণ নায়ক আর রাম খলনায়ক? উল্টোমি হচ্ছে? ওঁর স্ট্যাচুকেও উল্টে দিন। ওঁর বই পোড়ান। একটাই ঝামেলা, সবাই মাইকেলকে খুব শ্রদ্ধা করে, কিন্তু কেউ মেঘনাদবধ পড়ে না। তাই, অভিনব খেলুন। মহা-জনপ্রিয় সুকুমার রায়কে কাঠগড়ায় চড়ান।
‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ একটা শিশুপাঠ্য নাটক, সেখানে কিনা রামের গোটা বাহিনীকেই জোকারের গুষ্টি হিসেবে আঁকা হচ্ছে! মানে, কচি মনগুলোকেই বিষিয়ে দেওয়া! জাম্ববান-সুগ্রীব ভিতুর ডিম, বানরসেনা গবেট কোরাস, কিন্তু যা অসহ্য: হনুমান কিনা ভাঁড়! হনুমানকে জাম্ববান যখন বিশল্যকরণী আনতে বলছেন, হনুমান বিভিন্ন অজুহাতে গড়িমসি, এত রাত্তিরে কিছুতে যাবেন না, বরং ভোরে উঠে আনবেন। এর আগেও তাঁর ল্যাজে কে মাড়িয়ে দিয়েছে তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। শেষে জাম্ববান বলেন, ‘‘যাবিনে কি রে ব্যাটা? জুতিয়ে লাল করে দেব।...’’ তার উত্তরেও হনুমান বলেছিলেন কান কটকট করছে, শেষে কলা বখশিস পেয়ে ওষুধ আনতে যান। এ সব কী? শুদ্ধশুচি মহাকাব্য নিয়ে এমন নীচ ইয়ার্কি? সেরেফ হর্রা তোলার জন্য পূজ্য বীরশ্রেষ্ঠদের মেরুদণ্ডহীন প্রতিপন্ন করা? হনুমান আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সুকুমার জানতেন না? কোটি কোটি বাঙালি যেখানে হনুমান চালিশা পড়ে প্যারালিসিস থেকে শুরু করে নেড়ি কুকুরের আক্রমণ হতে পরিত্রাণ পাচ্ছে, সেখানে তাঁকে দেখানো হচ্ছে ফাঁকিবাজ, সঙ্কটমোচনে অনিচ্ছুক? সুকুমারের মূর্তি না থাকলে গড়তে দিন, আছড়ে ভাঙুন। ঘোটালা তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারলে, মিডিয়ায় হিস্টিরিয়া। তার পর নিয়মিত গ্ল্যামারাস ভাঙচুর অভ্যেস হয়ে গেলে, মূর্তির প্রক্সিতে থেমে থাকার দরকার নেই। মরা বলতে বলতে রাম হল, সুকুমার বলতে বলতে মার বেরবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy