Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
‘পুলিশ ও তাদের আশ্রিত গুন্ডাদের’ সামনে নিরস্ত্র নাগরিক
IIM

হিংসার ‘আমরা-ওরা’

আন্দোলন করতে এসে যারা প্রাণ হারাচ্ছে, ‘আত্মরক্ষার খাতির’-এ তাদের উপর গুলি-লাঠি চালিয়েছিল পুলিশ। প্রথমে অবশ্য পুলিশ গুলিচালনা অস্বীকার করে।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

পাবলিকের হিংসার বড় নিন্দা হচ্ছে। হিংসার বাম দক্ষিণ বিচারও দেখা হচ্ছে। বামেদের হলে খারাপ, দক্ষিণের হলে ঠিক, বা উল্টোটা। পাথর ছোড়া, ট্রেন-বাস জ্বালানো নিশ্চয়ই খুব খারাপ। মুখোশ পরা গুন্ডা দিয়ে, ছাত্র পেটানোও তাই। আন্দোলন হওয়া চাই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু হবে কী করে? আইআইএম-এর গেটের সামনে, এয়ারপোর্টে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ১৪৪ ধারা। জেলায়-শহরে ১৪৪ ধারা, যারা পুলিশের গুলিতে মারা গেল, তাদের বাড়ির সামনে-পিছনে ১৪৪ ধারা। তা হলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হবে কী করে? জমায়েত যদি নিষিদ্ধ হয়, তা হলে অনেকে জড়ো হলেই তা আইনভঙ্গ, অর্থাৎ ‘অশান্তি’, আর তখনই পুলিশের ‘অ্যাকশন’ শুরু। একটু খুঁটিয়ে আইন পড়লে দেখা যায়, কেন ১৪৪ ধারা ঘোষণা করা হবে তা জানানোর প্রয়োজন আইনে বা পুলিশ ম্যানুয়ালে লেখা নেই। পুলিশকে শুধু মনে করতে হবে যে, শান্তিভঙ্গ হতে পারে।

আন্দোলন করতে এসে যারা প্রাণ হারাচ্ছে, ‘আত্মরক্ষার খাতির’-এ তাদের উপর গুলি-লাঠি চালিয়েছিল পুলিশ। প্রথমে অবশ্য পুলিশ গুলিচালনা অস্বীকার করে। শেষে সারা দেশ জেনে গেল বলে, ‘খতিয়ে দেখছি।’ ‘আত্মরক্ষার খাতির’ কথাটা পুলিশ ম্যানুয়ালে ও ফৌজদারি বিধিতে লেখা আছে। তাই পুলিশ সেটাই বলে। অনেকটা ‘মেয়ের বিয়ে আঠারো বছরে দিয়েছি’, বলার মতো। কপট নিয়মরক্ষা।

তবু, কার হিংসা খারাপ আর কার হিংসা ভাল, বুঝব কী করে? দুই মহাপণ্ডিত ম্যাক্স ওয়েবার আর জ্যাক হবস বলেছিলেন হিংসা রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার। রাষ্ট্র আইনের উপরে প্রতিষ্ঠিত, কাজেই পুলিশ বা সেনা যা করে আইনবলে করে। রাষ্ট্রকে সাবধান করে তাঁরা বলেছিলেন, হিংসা যে হেতু তোমার একচেটিয়া অধিকার, তাই যথেষ্ট নিয়ম বানাতে হবে যাতে হিংসা সঙ্গত কারণে হয়। আইনি হিংসার কথা ভারতীয় দণ্ডবিধি (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড), পুলিশ ম্যানুয়াল আর ফৌজদারি আইনে (সিআরপিসি) লেখা আছে। বিচারপতিরা নানা সময়ে সেগুলি আরও সঙ্গত করার চেষ্টা করেছেন। মুম্বই পুলিশ দু’বছরে ৯৯টা ‘এনকাউন্টার’-এ মোট ১৩৫ জনকে মেরে ফেলার বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলায় রায়ে (২০১৪) বলে, এমন প্রতিটি হত্যার তদন্ত স্বতন্ত্র তদন্ত করতে হবে। তদন্তের নিয়মাবলিও লিখে দিয়েছিলেন বিচারপতিরা।

পুলিশের ম্যানুয়ালে লেখা থাকে, লাঠি শরীরের কোথায় চালাতে হবে, গুলিচালনার আগে মাইকে ‘গুলি চালাতে হতে পারে’, এই সতর্কবার্তা দিতে হবে ইত্যাদি। কেরলের পুলিশ ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে, শূন্যেও গুলি চালানো যাবে না।

এই সব বিধি মানলে রাষ্ট্রের হিংসাকে ‘ভাল হিংসা’ বলা যাবে। আর খারাপ হিংসা? পাবলিকের যে কোনও হিংসাই খারাপ। পুলিশের বইতে তাই লেখা আছে। শুধু মনে রাখা চাই, এই সব নির্দেশিকা অধিকাংশই সাহেবদের লেখা। স্বাধীন ভারতে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে, মূল কথাগুলো একই থেকেছে। সংবিধানের ১৯(ক) ধারায় নাগরিক জমায়েতের যে মৌলিক অধিকার আছে, তা ‘নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ’ হতে হবে। এবং তা সত্ত্বেও পুলিশ তা বন্ধ করে দিতে পারে, শান্তিরক্ষার নামে। শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র জমায়েত পুলিশ হটিয়ে দিতে পারবে না, এমন কথা সংবিধানেও নেই, পুলিশের ম্যানুয়ালে বা ফৌজদারি বিধিতেও নেই।

শান্তিপূর্ণ জমায়েতের জন্যেও পুলিশের লিখিত অনুমতি লাগে। পুলিশের অনুমতি না দেওয়ার শর্ত কী, কোথাও লেখা নেই। যা পাওয়া যায়, তা হল পুলিশ আত্মরক্ষার খাতিরে কী কী করতে পারে তার লম্বা ফিরিস্তি। পাবলিক আত্মরক্ষার খাতিরে কী কী করতে পারে কোথাও লেখা নেই। যেমন, বিনা অনুমতিতে পুলিশ বা তাদের আশ্রয়ে গুন্ডারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে ছাত্রেরা কী করতে পারে লেখা নেই। পুরুষ পুলিশ মেয়েদের হস্টেলে ঢুকলে মেয়েরা আত্মরক্ষার খাতিরে কী করবে, পুলিশ কাউকে ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’ বললে সে কী করতে পারে, কোথাও লেখা নেই। পুলিশ ম্যানুয়ালে লেখা আছে, মাথায় লাঠির আঘাত করা যাবে না। পুলিশ যদি তা করে তা হলে মানুষ আত্মরক্ষার খাতিরে কী করবে, তা-ও কোথাও লেখা নেই।

আর একটা ব্যাপারে মারাত্মক ধন্দ লাগছে। ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করবে, গুলি চালাবে, তা ম্যানুয়ালে লেখা আছে। এমনকি ঘোষণা করার সময়ে ‘ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চালানো হতে পারে’ এই কথা চেঁচিয়ে বলতে হবে, বা কোন উচ্চতায় গুলি চালাতে হবে, তা-ও। কিন্তু ‘ছত্রভঙ্গ করা’ আর মানুষ মেরে দেওয়া কি এক? না কি এটা ‘আমি তো মারিনি, ও মরে গিয়েছে’-র মতো ব্যাপার?

পুলিশের ম্যানুয়াল আর ফৌজদারি বিধি খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, আততায়ীকে খুঁজতে পুলিশ যে কোনও বাড়িতে কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়াই ঢুকে পড়তে পারে, বাড়ি সার্চ করতে পারে, এমনকি আততায়ীকে মেরে ফেলতে পারে (আইনি ভাষায়, হট পারশুট)। তা বলে মহিলা, কিংবা বয়স্কদের পেটাতে পারে, আসবাব ভাঙচুর করতে পারে, এ কথা লেখা নেই। কিন্তু নানা রাজ্যে পুলিশ তা করছে। গৃহস্থ, বিশেষত মহিলা-বৃদ্ধেরা আত্মরক্ষা ও সম্পত্তি রক্ষার খাতিরে কী করবে? বলা নেই কোথাও। নাগরিকের আত্মরক্ষার ম্যানুয়াল নেই।

সমস্যাটা গভীর। আঠারো-উনিশ শতকে যে সব রাষ্ট্রের জন্ম, তাদের একটা দিকে ছিল গণতন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, জনকল্যাণ, ন্যায়, যুক্তি আর নীতি। অন্য দিকে দুনিয়ার তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে ছিল উপনিবেশ, এগুলোর কোনওটা তাতে ছিল না। ভারতের সংবিধান নাগরিককে বহু অধিকার দিয়েছে, কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের খোলস থেকে পুরোপুরি বেরোতে পারেনি। আপস রয়ে গিয়েছে। তাই জনগণের শান্তিপূর্ণ জমায়েতের মৌলিক অধিকার নিঃশর্ত নয়। কিন্তু ১৪৪ ধারা শর্তহীন।

গত কয়েক সপ্তাহে দেশে যা ঘটছে, তা এ দেশে নতুন নয়। প্রতিবাদ মিছিল থেকে পাথর বৃষ্টি, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, পুলিশের ও পোষা গুন্ডাদের নির্মম অত্যাচার, সবই চেনা ছবি। তবু আগেও দেখেছি, এখনও দেখছি, যেখানেই বিশাল জমায়েত হয়েছে, সাধারণত তা শান্তিপূর্ণ। বরং গান, কবিতা, পোস্টার, স্লোগানের নান্দনিক উৎকর্ষ বহু নাগরিক মিছিলে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। পুলিশের ছবিটা কিন্তু গত বাহাত্তর বছরে বদলায়নি। ১৪৪ ধারা জারি করে মানুষের জমায়েত-প্রতিবাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, ‘আত্মরক্ষায়’ কিংবা ‘ভিড় ছত্রভঙ্গ’ করতে গুলি চালানো, এলাকায় ঢুকে মানুষ পেটানোর ছবির বাইরে কোনও ছবি দেখছি না।

তাই একটা কাজ জরুরি হয়ে পড়েছে। তা হল, পুলিশের ও তাদের আশ্রয়ে গুন্ডাদের সন্ত্রাস থেকে আত্মরক্ষার নাগরিক ম্যানুয়াল তৈরি করা।

পুলিশের অত্যাচারের খুঁটিনাটি আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। পুলিশ যা করে তা যদি সব ম্যানুয়াল মেনেই করে, তা হলে মানুষকে যা করতে হবে, তারই বা ম্যানুয়াল থাকবে না কেন?

প্রশ্ন উঠবে, নাগরিক ম্যানুয়ালের নৈতিক ভিত্তি কী? উত্তর হল, আত্মরক্ষার অধিকার মানুষের একটা নৈতিক অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা সাংবিধানিক অধিকার নয়।

ফৌজদারি বিধির ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় তার উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ৯৯ ধারাতে বলা হচ্ছে, সরকারি লোকের কোনও কাজের থেকে নাগরিকের আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত কেবলমাত্র প্রাণভয় বা গুরুতর আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে। তার মানে এ দেশে সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার অধিকারের জোরালো কোনও আইনি ভিত্তিই তৈরি হয়নি। অনেকে আশঙ্কা করবেন, নাগরিকের অধিকার বাড়িয়ে পুলিশের ক্ষমতা কাটছাঁট করলে হিংসা আরও বাড়বে। সেই ঝুঁকি মাথায় রেখেই বলা চলে, পুলিশ ও তাদের আশ্রিত গুন্ডাদের সন্ত্রাস থেকে নাগরিকের আত্মরক্ষা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা বড় জরুরি হয়ে পড়েছে।

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

IIM JNU
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy