শৌচাগার। ফাইল ছবি।
গ্রামের নাম বড়িয়া। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী গ্রামে রামকুমার বেইগা’র নিকানো উঠোনে খাটিয়া পেতে বসেছিলাম। বাড়ির মূল প্রবেশপথের এক দিকে সার দিয়ে ঘর। অন্য দিকে মাটির দেওয়াল ঘেঁষে এক চিলতে একটা ঘর। টিনের চাল। পাশে একটি বেসিন লাগানো। কিন্তু জলের জোগানের কোনও পথ দেখলাম না। ওই ঘরটি শৌচালয়। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ১১ হাজার টাকা।
দু’বছর আগে তৈরি হওয়া শৌচাগারটি এক দিনের জন্যও ব্যবহার করেনি বেইগা পরিবার। গ্রামের ১৫টি বাড়ির সব ক’টিতেই শৌচাগার তৈরি হয়ে পড়ে আছে। সরকারি অফিসার অবশ্য জানিয়ে দিলেন, ‘‘আমাদের গ্রামের সবাই শৌচাগার ব্যবহার করেন।’’ কিন্তু জল পান কোথা থেকে? হোঁচট খান রামলখন। তাঁর ক্লাস ফোরে পড়া নাতিটি পাশ থেকে বলে, ‘‘এখানে তো গরুর খাবার রাখা হয়। আমরা সবাই মাঠে যাই।’’
সরকারি নথি বলছে, গ্রামের সবাই শৌচাগার ব্যবহার করছেন। নিরন্তর প্রচারে বদলে গিয়েছে মানুষের বদভ্যাস। বাস্তব চিত্র বলছে, শৌচাগার তৈরি করেই দায় সেরেছে প্রশাসন। কেন মাঠে নয়, কেন যেতে হবে শৌচাগারে তা জানাতে এক দিনের জন্যও কোনও সরকারি আধিকারিক প্রচারে যাননি ওই গ্রামগুলিতে। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প সফল হওয়ায় ওই সব গ্রাম উঠে গিয়েছে নির্মল গ্রামের তালিকায়।
গ্রামের নাম দমদমা। বীরভূমের বোলপুর-সাঁইথিয়া রাজ্য সড়ক থেকে কংক্রিটের যে রাস্তাটি নেমে গিয়েছে গ্রামের দিকে, সেখানে রয়েছে একটি সাইনবোর্ড, ‘‘আপনি একটি উন্মুক্ত শৌচহীন সংসদে প্রবেশ করছেন। এখানে কেউ উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম করে না। এর জন্য আমরা গর্বিত।’’ গ্রামের আদিবাসী পাড়ায় গেলে কিন্তু সাইনবোর্ডের কথাগুলি নিশ্চিত বিদ্রুপ মনে হবে। নির্মল গ্রামের আদিবাসী পাড়া সকাল-সন্ধ্যা মাঠে যাওয়ার অভ্যাস এখনও ছাড়তে পারেনি। ঘন বর্ষাতেও সকালে গোটা গ্রাম মাঠমুখী। নারী-পুরুষের মাঠ আলাদা।
কেন? নির্মল বাংলা প্রকল্পে প্রতিটি বাড়িতে শৌচাগার বসেছে। গ্রামে জলের সরবরাহও অপ্রতুল নয়। তা হলে কেন মানুষ মাঠে যাচ্ছেন? জবাব নেই গ্রামবাসীদের মুখে। এক নবীন জানালেন, ‘‘অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে!’’ মাঠেঘাটে শৌচকর্মে যে রোগজীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে সে কথা তাঁদের কখনও কেউ বলেননি বলে জানিয়েছেন এক প্রবীণা। পঞ্চায়েতের এক কর্তার স্বীকারোক্তি: ‘‘যে ভাবে প্রচার হওয়ার দরকার ছিল সে ভাবে হয়নি।’’ ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ বীরভূমকে ‘নির্মল জেলা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালে ৪ লাখ ৭৮ হাজার বাড়িতে শৌচাগার ছিল না। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, সে জেলায় ৭০ শতাংশ মানুষ (রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি) মুক্ত শৌচকর্মে অভ্যস্ত ছিলেন। বাড়ি বাড়ি শৌচাগার গড়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা মোটেই সহজ ছিল না।
অর্থাৎ, মধ্যপ্রদেশের বড়িয়া ও পশ্চিমবঙ্গের দমদমা এক বন্ধনীতে। খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য বন্ধে ১৯৯৯ সালে নির্মল ভারত অভিযানের সূচনা করে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার। সেই প্রকল্পের ব্যাপ্তি বাড়াতে ২০১৪-য় ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ নামে প্রকল্পটির নতুন নামকরণ করে। ২০১৯-এ ওই প্রকল্প পুরোপুরি কার্যকর করার লক্ষ্যমাত্রাও ধার্য করে কেন্দ্রীয় সরকার। ওই প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ নেই। ২০১৪-র ২ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন মোড়কে ‘মিশন নির্মল বাংলা’ নামে সমান্তরাল প্রকল্প চালু করেন। দু’টি প্রকল্পের উদ্দেশ্য এক। বাড়ি বাড়ি শৌচাগার তৈরি করে, মাঠেঘাটে শৌচকার্য বন্ধ করা।
এ বার বাজেট পেশের সময় একটি সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ কোটি গ্রামীণ বাড়িতে এবং ১ কোটি শহুরে বাড়িতে শৌচালয় ছিল না। সারা দেশে প্রায় ৫৭ কোটি মানুষ খোলা জায়গায় শৌচকার্য করতেন। গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে বলে ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, মার্চ ২০১৫ থেকে মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত যে সব গ্রামে বেশি মাত্রায় শৌচাগার তৈরি হয়েছে এবং মানুষ তা ব্যবহার করছেন সেখানে আন্ত্রিক, ম্যালেরিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার অনেকটাই কমেছে। কমেছে মৃত শিশু প্রসব, কিংবা খুব কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হারও।
এই ছবি কতটা সত্য? ২০১৮ সালের এক সমীক্ষা বলছে, রাজস্থান, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশে যে সব গ্রামে শৌচাগার বসেছে সেখানে যত মানুষ আগে খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য করতেন, তাঁদের ৪৪ শতাংশ পুরনো অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটাননি। আগে থেকেই বাড়িতে শৌচাগার রয়েছে, এমন ২৩ শতাংশ মানুষ চার বছরেও অভ্যাস বদলাননি।
অভ্যাস বদলানোর জন্য চাই ব্যাপক প্রচার। তা না হলে কিন্তু দমদমা, বড়িয়ার মতো গ্রামের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy