ধর্মে প্রত্যয় ছিল না, জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসের প্রশ্নই উঠে না। তবু সময়রথে চড়িয়া বা কালচক্রের আবর্তনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দুইশত বৎসর পরে আজিকার বঙ্গসমাজে ফিরিয়া আসিলে সুখ পাইতেন বলিয়া মনে হয় না। স্বস্তি তাঁহার নিজকালেও ছিল না, সমাজের সংস্কার করিতে গিয়া প্রশাসন ও জনসাধারণ হইতে কম বাধা পান নাই। কিন্তু একুশ শতকে আসিলে দেখিতেন, তিনি পড়িয়া গিয়াছেন রাজনীতির দড়ি টানাটানিতেও। গত বৎসরের ঘটনা মনে পড়িতে পারে, কলিকাতায় তাঁহারই নামাঙ্কিত কলেজে তাঁহার মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ হইয়াছিল। উহা ছিল লোকসভা নির্বাচন-তপ্ত কলিকাতা, দুই রাজনৈতিক দলের কোন্দলের মধ্যে বিড়ম্বনায় পড়িয়া গিয়াছিলেন বিদ্যাসাগর। তাহা লইয়া তোলপাড় হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর বাঙালির কী ও কেন তাহা বুঝাইবার চেষ্টায়, কে বা কাহারা তাঁহার মূর্তি ভাঙিতে পারে সেই রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ হইয়াছিল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিদ্যাসাগর স্বমূর্তি ফিরিয়াও পাইয়াছিলেন। স্বমূর্তি ধরিলে কী হইত বলা যায় না। জীবদ্দশায় ভগ্নহৃদয়ে কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছিলেন, এখন হয়তো ক্রোধজর্জর হইয়া ছাড়িয়া যাইতেন। জুলাইয়ে তাঁহার প্রয়াণদিনে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শ্রদ্ধা-টুইট বা জন্মদ্বিশতবার্ষিকীতে বঙ্গ-রাজনীতিককুলের স্মরণার্ঘ্য, কিছুই তাঁহাকে টলাইতে পারিত না।
এই কাল্পনিক ক্রোধের কারণ, তাঁহাকে লইয়া রাজনীতির রবরবা। উনিশ শতকের বহু বঙ্গ-মনীষীকেই রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শ কব্জা করিয়াছে। বিবেকানন্দ বৃহত্তম প্রমাণ, বঙ্কিমচন্দ্র হইতে রবীন্দ্রনাথও ‘অপহৃত’ হইয়াছেন, খোদ প্রধানমন্ত্রীর বার্তায় বারংবার উঠিয়া আসিয়াছে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ। ভূমিপুত্র মনীষীদের তুলিয়া ধরিলে স্থানিক জনতার মন পাওয়া সম্ভব। এই তালিকায় বিদ্যাসাগরের খোঁজ বিশেষ পড়ে নাই, কারণ তাঁহার ভূরি ভূরি উদ্ধৃতিযোগ্য বাণী নাই, তাঁহাকে সামলানো সহজ নহে। অথচ বাঙালিসত্তার তিনি অবিসংবাদিত ও সমার্থক অস্তিত্ব। বিদ্যাসাগর না পড়িয়াই, বা না পড়িয়াও বাঙালি জানে, আজ যে বাংলা ভাষার ও শিক্ষাব্যবস্থার ফসল সে ঘরে তুলিতেছে, তাহা বিদ্যাসাগরের দান, তাঁহারই কৃতি ও কীর্তি। আক্ষরিক অর্থে তাঁহার মুণ্ডপাত— তাহা পাঁচ দশক আগেই হউক কি সম্প্রতি— বাঙালিসত্তার চরমতম বিপর্যয়। তাঁহার অবমাননায় বঙ্গমনন ব্যথিত, পীড়িত হয়। বিদ্যাসাগর নিজে দেখিলে হয়তো হাসিতেন, কারণ মূর্তি বা ভাবমূর্তি কোনওটিই রক্ষার দায় তাঁহার ছিল না। বলিতেন, তাঁহার বিস্তর কাজ পড়িয়া আছে, এবং সময় স্বল্প। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ওরিজিন্যাল’ বা ‘অনন্যতন্ত্র’ এই মানুষটি ক্ষুদ্রকর্মা ভীরুহৃদয়ের দেশে ‘উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে’ লইয়া গিয়াছেন। প্রতি পদে প্রতি কাজে বুঝাইয়া দিয়াছেন, ইহাই ধর্ম, ইহাই মোক্ষ, ইহাই বাঙালির সাধ্য ও সাধনা। আজকের রাজনীতির কারবারিরা তাহা না বুঝুন বা ভুল বুঝুন, বঙ্গবাসীকে ঠিক বুঝিতে হইবে।
বুঝিতে হইবে, আজ যে বাঙালি জাতিসত্তার সংজ্ঞা ও উপাত্ত লইয়া রাজনীতি হইতেছে, বিদ্যাসাগর জীবন দিয়া সেই সত্তার নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন। বাংলার ভাষা, শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রতিটি পরিসরে আপসহীন নিরলস লড়িয়া তাহাদের প্রতিষ্ঠা দিয়াছেন। বাঙালি যে আজও শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়, শিক্ষক ও শিক্ষাসাধকদের শ্রদ্ধা করে, অন্তরবস্তুর চর্যাকে সাধনা বলিয়া মানে, তাহার মূলে ওই ধুতি-চাদর পরিহিত সহজ ও বলিষ্ঠ মানুষটির জীবন। দয়া ও মনুষ্যত্বে, হিতৈষা ও প্রজ্ঞায়, তত্ত্বে ও সত্যে তিনিই বাঙালিসত্তার নির্যাস, তিনিই স্তম্ভ। তাঁহার দেখানো পথে বিদ্যাচর্চা, যুক্তিবাদ, মানবিক সাম্য দীর্ঘ কাল ধরিয়া বঙ্গজীবনের গর্ব ছিল, এখনও আছে। ভবিষ্যতে থাকিবে কি না, সময়ই বলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy