ছেলেবেলার রচনা বইতে বিদ্যাসাগরকে ‘দয়ার সাগর’ বলা হত। কথাটা আমরা নির্বিচারে মেনে নিয়েছি। করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের দয়াধর্ম নিয়ে কত যে গল্প ইতিউতি ছড়ানো, কিন্তু সেই দয়াধর্মের স্বরূপ বিচার করার চেষ্টা করিনি আমরা।
আমবাঙালি গল্প শুনতে ভালবাসে, বিশ্লেষণ ও অনুশীলন করতে চায় না। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ ‘দয়া’ নিয়ে বাংলায় কথা সাজিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সে বইতে কেন জানি না বিদ্যাসাগরের দয়াধর্মের উল্লেখ নেই। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর চারিত্রপূজা-র অন্তর্গত বিদ্যাসাগরচরিত-এ জানাতে ভোলেননি: ‘‘ভগবতী দেবীর অকুণ্ঠিত দয়া তাঁহার গ্রাম, পল্লী, প্রতিবেশীকে নিয়ত অভিষিক্ত করিয়া রাখিত। রোগার্তের সেবা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান এবং শোকাতুরের দুঃখে শোকপ্রকাশ করা তাঁহার নিত্যনিয়মিত কার্য ছিল।’’ ভগবতী দেবীর এই অকুণ্ঠিত দয়া বিদ্যাসাগরকে প্রভাবিত করেছিল সন্দেহ নেই, তিনিও রোগার্তকে সেবা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান করতেন। লোকের দুঃখের কথা শুনলে চোখের জল ধরে রাখতে পারতেন না। বিদ্যাসাগরের দয়াধর্ম কিন্তু কেবল মায়ের অকুণ্ঠিত আবেগমাত্র ছিল না, দয়াধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর উনিশ শতকের বঙ্গদেশের স্থিতাবস্থা কায়েমকারী সামাজিক কাঠামোকে আঘাত করতে চেয়েছিলেন।
কাকে বলে দয়া? ভাগবতে বলা হয়েছিল, ‘যত্নাদপি পরক্লেশং হর্ত্তুং যা হৃদি জায়তে’ তাই দয়া। অপরের কষ্ট হরণের জন্য হৃদয়ানুভবই দয়া। দয়া শুধু ব্যক্তিহৃদয়কে দ্রবীভূতই করে না, সেই হৃদয়াবেগ দয়াশীল ব্যক্তিকে কর্মেও প্রবৃত্ত করে। বিদ্যাসাগর দয়াকার্যে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন বিধবাবিবাহ প্রচলন প্রচেষ্টা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এ-কাজ তাঁর দয়াবৃত্তিরই প্রকাশ। তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব রচনাটিতে তিনি কেবল শাস্ত্রবিচার করে বিধবাবিবাহের বিধান দেননি, বঙ্গদেশের পাঠকসমাজের মন যাতে বিধবা রমণীদের দুর্দশায় কাতর হয়, সে-জন্য প্রস্তাবের শেষে লেখেন, ‘‘তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এক কালে নির্ম্মূল হইয়া যায়।’’
এক জন পুরুষ স্ত্রীশরীরের সঙ্গত দাবিকে ভাষায় প্রকাশ করছেন, এ খুব সহজ কাজ নয়। সে-সময় স্ত্রীশরীর পুরুষ অধিকারের অন্তর্গত, এখনও বহু ক্ষেত্রে তাই। পুরুষের মৃত্যুর পর সে শরীরের পরিণতি কী হবে, তাও পুরুষশাসিত সমাজ স্থির করে দেয়। রামমোহন সতীদাহ প্রথা রদ করার আন্দোলন করে ভারতীয় নারীর জীবনের অধিকার আইনসঙ্গত ভাবে প্রদানের পথ প্রস্তুত করেছিলেন। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ ভেবেছেন, রামমোহন যখন লেখেন সতীর ‘মরণকালীন কাতরতাতে তোমাদের দয়া জন্মে না’ তখন তিনি ‘স্মৃতিশ্রুতিকে উপেক্ষা করেই’ যুক্তির আবেদন যেন সোজাসুজি অভিজ্ঞতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। চিতার উপর নারীশরীর দেখার অভিজ্ঞতা কটু, সন্দেহ নেই। যে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে গুহ নীরব, সেই বিদ্যাসাগর আবেদন করছেন বাঙালির সংবেদনের কাছে। অভিজ্ঞতার কাছে পৌঁছনোর চেয়ে সংবেদনের কাছে পৌঁছনো কঠিন।
পৌঁছনোর উপায় ভাষা। বিদ্যাসাগরের ভাষা রামমোহনের চেয়ে বেশি পাঠকের মনোগ্রাহী সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষাকে তিনি দয়াসঞ্চারের জন্য উপযুক্ত ও শিল্পসম্মত করে তুলতে পেরেছিলেন। এ সম্ভব হয়েছিল, কারণ সংস্কৃত কলেজের এই ভাল ছাত্রটি বার বার নানা সূত্রে কলেজের পড়ুয়াদের মুখের ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজের ভাষার সামাজিকতা আর গুরুত্ব কতটা, তা এই কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষটি জানতেন। দয়াবৃত্তির সঞ্চার ভাষাসাপেক্ষ।
নারীশরীরের যে বেদনার কথা তিনি প্রকাশ করেছেন, নিরাময়ের দাবি উত্থাপন করেছেন, তা পুরুষের মনে তখন রেখাপাতই করত না। বিধবাদের ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়ে ক্ষণিক ভোগ করে পতিতালয়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার ‘পুরুষালি’ কাণ্ড অবশ্য উনিশ শতকে প্রায়ই ঘটত। রবীন্দ্রনাথ তাই বিদ্যাসাগরের এই সংস্কার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘‘বিধবাগণকে অতলস্পর্শ অচেতন নিষ্ঠুরতা হইতে উদ্ধার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।’’ পুরুষের সামাজিক মনের অতলস্পর্শ অচেতন জায়গাটিতে আঘাত করাই দয়াশীল বিদ্যাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বিদ্যাসাগর তাঁর দয়াবৃত্তির অনুশীলনে সামাজিক বর্ণভেদকে আঘাত করতে পেরেছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় গ্রামে অন্নসত্র খুললেন। দরিদ্র নিম্নবর্ণীয় নারী-পুরুষ সেখানে আসতেন। তাঁদের শরীরের দিকে তাকিয়ে বিদ্যাসাগরের মন ক্লিষ্ট। রুক্ষ তৈলহীন রমণীদের দেখে মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর কাতর। শুধু ভাতের নয়, গা-মাথার তেলের ব্যবস্থাও করলেন তিনি। গ্রামের মুদির দোকানে দরিদ্রদের জন্য তেলের কথা বলা ছিল। বর্ণবিভক্ত সমাজে মুদি নিম্নবর্ণের মানুষদের যে ভাবে তা দিতেন, তা দেখে বিদ্যাসাগর বিরক্ত। দরিদ্র অস্পৃশ্য মানুষগুলির মাথার রুক্ষ চুলে পরম মমতায় তেল মাখাতেন তিনি।
তাঁর দয়াধর্মের মধ্যে শরীর-মনের মমতাময় স্পর্শ লেগে থাকত। উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের সামাজিক অসম্বন্ধ এতে মুছে যেত। জীবনের শেষ পর্বে এই ব্রাহ্মণসন্তান সাঁওতালদের মধ্যে যে আপনমনে আপন ভাবে থাকতে পেরেছিলেন, তা দয়ার অনুশীলনের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিবরণ থেকে জানা যায় সাঁওতালরা এই মানুষটিকে নিজেদের লোক বলেই মনে করতেন।
বিদ্যাসাগর তাঁর দয়াধর্মের অনুশীলনে নিজের বর্ণগত অবস্থান থেকে নেমে কেবল সাধারণের সঙ্গে মিশে গেলেন না, যে-কোনও বর্ণের মানুষই যে দয়া ও দান ধর্মের অনুশীলনে নিজের বর্ণগত সামাজিক দীনতাকে অস্বীকার করতে পারেন, তা-ও প্রচার করলেন। মহাভারতের বনপর্বে কৌশিক ব্রাহ্মণ ও ধর্মব্যাধের কাহিনি আছে। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, এই কাহিনিটি বঙ্গদেশে কাগিবগির কাহিনি নামে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই কাহিনিতে ধর্মব্যাধ কৌশিক ব্রাহ্মণকে উপদেশ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘‘আমি কুলোচিত কর্ম করি।’’ অর্থাৎ, অন্যে যে বরাহ বা মহিষ মারেন, ব্যাধ তা বিক্রি করেন। কুলবৃত্তি পালন করেন বলে, তাঁর মনে কোনও দীনতা নেই। ব্রাহ্মণকে ব্যাধ বলেন ‘‘অসূয়া করি না, যথাশক্তি দান করি।’’ এই কাহিনিতে বর্ণবিভক্ত সমাজের লোকাচার ও কুসংস্কার নির্দিষ্ট ব্রাহ্মণ্য তঞ্চকতার বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ব্যাধ সৎ ভাবে নিজবৃত্তি পালন করেন। তাই তিনি ব্রাহ্মণকে উপদেশ দিতে পারেন। দানধর্মের অধিকার তাঁর আছে।
বিদ্যাসাগর তাঁর চরিতাবলী-তে বাঙালি ছাত্রদের জন্য পরিশ্রম ও অনুশীলনের ফলে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত যে বিদেশি চরিত্রগুলির কাহিনি লিখেছিলেন, তাঁরা সবাই সমাজের নিচুতলার মানুষ। তাঁদের কারও বাবা চাষা, কেউ মজুর, কেউ তাঁতি। এই খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলেগুলি জীবনে নানা দয়াশীল ব্যক্তির সংস্পর্শে আসছেন। সেই দয়াশীল ব্যক্তিরা সকলে অভিজাত নন। বাড়ির সামান্য পরিচারিকার দয়ায় পড়াশোনা সহজ হয়েছে, এমন উদাহরণ সে-কাহিনিতে রয়েছে। দয়া এমন গুণ, যা উচ্চবর্ণকে তার উচ্চতার অহমিকা ভুলে যেতে সাহায্য করে, নিম্নবর্ণকে আত্মমর্যাদা দেয়। বিদ্যাসাগর তা জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন।
কলকাতা শহরে জীবিকার খোঁজে আসা পিতা ঠাকুরদাস তখন ইংরেজি শিখছেন। যে বাড়িতে তিনি আশ্রিত, সে বাড়ি ফিরতে তাঁর রাত হয়ে যায়। তখন তাঁদের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে যেত। রাতে না খেয়ে বিদ্যাসাগরের পিতা রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন। ইংরেজি শিক্ষককে যখন এ কথা বলছিলেন তিনি, তখন সেখানে আর এক জন ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর তাঁর অসম্পূর্ণ ‘আত্মচরিত’-এ জানিয়েছিলেন, ‘‘...সেই স্থানে, শিক্ষকের আত্মীয় শূদ্রজাতীয় এক দয়ালু ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।’’ ঠাকুরদাসকে তিনি নিজগৃহে রাখতে সম্মত হলেন। স্থির হল ঠাকুরদাস নিজে রান্না করে খাবেন। ব্রাহ্মণ শূদ্রের রান্না খাবে, এই সংস্কার ত্যাগ করতে না পারলেও ব্রাহ্মণ শূদ্রের দয়া গ্রহণ করবে, এতে ঠাকুরদাস সম্মত হয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের দয়াধর্মের এই সামাজিকতার কথা পড়তে পড়তে বঙ্কিমের ধর্মতত্ত্ব-এর দয়া নামের অধ্যায়টির কথা মনে পড়ে। সেখানে বঙ্কিম বড়লোক মানুষের টাকা দেওয়াকে যথার্থ দয়া বা দান বলতে নারাজ। তাঁর মতে, এই অনেক থাকা মানুষের টাকা ছেটানো তেমন বাহাদুরি নয়, এতে কেবল প্রমাণিত হয় সেই মানুষটি ‘নরাধম’ নন। প্রকৃত দয়াধর্ম ‘আত্মোৎসর্গ’। বিদ্যাসাগর সামাজিক দয়ায় আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, অর্থাৎ নিজের শ্রেণি ও বর্ণগত উচ্চতাকে সমাজের হিতের জন্য উৎসর্গ করে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অতিমারির সময় আমরা যাঁরা ছুটকো-ছাটকা টাকা ছিটিয়ে বাহাদুর বলে নাম কিনতে চাই, তাঁরা বিদ্যাসাগরের এই দয়াবৃত্তির সামাজিকতা মনে রাখলে পারি। তাতে আমাদের শ্রেণিগত অবস্থান দেওয়াল ভেঙে সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy