লকডাউনে আর্থিক ভাবে এমনিতেই বিপন্ন মুর্শিদাবাদ। কয়েক লক্ষ শ্রমিক ভিন্ রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে ফিরেছেন শূন্য হাতে। জেলায় শিল্প বলতে বিড়ি, তাতেও চূড়ান্ত অচলাবস্থা। বাকি ছিল আম, লিচু ও কৃষিক্ষেত্রের ফসল। আমপানের ধাক্কায় বিধ্বস্ত তার অনেকটাই। ফলে পিছিয়ে পড়া মুর্শিদাবাদ চরমতম আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে বলেই মনে করছেন অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা তা বলছেন, আগামী ৬-৭ মাস এ জেলা এক কঠিন সঙ্কটময় অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাবে। যা জেলার আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
মুর্শিদাবাদের বেশির ভাগ মানুষই জানে তিনটি কাজ। রাজমিস্ত্রির কাজ, নির্মাণ শিল্পে দিনমজুরি ও হকারি। এই তিনটি কাজ নিয়েই তারা ভিন রাজ্যে কেউ যাচ্ছে ২০ বছর, কেউ ১৫ বছর। জেলায় রাজমিস্ত্রির মজুরি ৫০০ টাকা। রাজ্যের মধ্যে বিভিন্ন শহরে সে মজুরি ৬০০ টাকার আশপাশে। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্তিসগঢ়ে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কেরলে সে মজুরি ৯০০ টাকা। টানা দু’চার মাস থাকলে মোটা অর্থ নিয়ে ঘরে ফেরেন তাঁরা। পরিবারও থাকে নিশ্চিন্তে। তাঁদের বেশিরভাগ বাড়িতেই মেয়েরা বিড়ি বাঁধেন। সেই বিড়ি থেকে সংসার চলে। ভিন্ রাজ্যে আয়ের জমানো টাকাই তাঁর পরিবারে আনে অনেকটাই স্বচ্ছলতা। তাই গ্রামে ভিন্ রাজ্যে যাওয়া বহু শ্রমিকের বাড়িই খুব তাড়াতাড়ি পাকা করে নিতে পারেন। ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকেরা বাড়িতে ফেরেন ইদ বা কোনও উৎসবের সময় মোটা টাকা হাতে নিয়ে। এ বার যা হয়নি।
কেরল সরকার তাঁদের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর একটি সমীক্ষা চালায় ২০১৭ সালে। সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ১৯৪টি জেলা থেকে সেখানে কাজে যান শ্রমিকেরা, তার অন্যতম মুর্শিদাবাদ।
প্রতি বছর কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে ২.৩৫ লক্ষ করে। কেরল থেকে বছরে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাত ধরে ১৭, ৫০০ কোটি টাকা শ্রমিকদের বাড়িতে যায়। এ রাজ্যে আসে তার ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৬২৫ কোটি টাকা। এই টাকার মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২৬২ কোটি টাকা প্রতি বছর শুধু কেরল থেকেই ঢোকে মুর্শিদাবাদ জেলায়। এ ছাড়াও ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু, বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম থেকেও মোটা অর্থ আসে এ জেলায়। এ বার এ সবের পুরোটাই বন্ধ। ৮০ লক্ষ মানুষের বসতি ঘন জেলায় কাজ হারিয়ে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফিরলে শেষ পর্যন্ত শিল্পহীন জেলার পরিস্থিতি সামলানো কার্যত একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে প্রশাসন ও সরকারের কাছে। জেলার অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, যে করেই হোক কাজ হারানো এই সব লোকগুলির হাতে কাজ দিতে হবে। শুধু সরকার দেবে তা নয়, এ ব্যাপারে জেলার বিত্তশালী প্রতিষ্ঠান ও মানুষগুলিকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজের সুযোগবাড়াতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত অর্থনীতির শিক্ষক জিয়াগঞ্জের কিশোর রায়চৌধুরী বলছেন, “প্রতি বছর বিভিন্ন রাজ্য থেকে কয়েকশো কোটি টাকা আসত মুর্শিদাবাদ জেলায়। জেলার অর্থনীতিতে যা ছিল বড় ভরসা । এবার সেটা নেই। জেলার ৪ থেকে ৫ লক্ষ শ্রমিক ফিরেছেন এবং ফিরছেন প্রায় শূন্য হাতেই। বিড়ি শিল্প প্রায় অচল। ভরসা ছিল আম, লিচু। আমপানের থাবায় তাও অনেকটাই ক্ষতির মুখে। ক্ষতির মুখে কৃষিও। ফলে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। কোনও অর্থনৈতিক তত্ত্ব নেই এর থেকে চটজলদি বেরিয়ে আসার। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত থাকলে আগের মতো খাদ্যের সঙ্কট হয়ত দেখা দেবে না। কারণ কৃষিক্ষেত্রে ফসলের উৎপাদন, কৃষি বৈচিত্র এত বেড়েছে এ জেলাতেও যে মন্বন্তরকে হয়তো সামাল দেওয়া যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেড়েছে বলে সচেতনতা বেড়েছে। এই ক্ষত সামাল দিতে কাজ সৃষ্টি করা জরুরি, যা স্থায়ী সম্পদ বাড়াবে ভবিষ্যতের জন্য। শুধু সরকার নয়, সামাজিক ক্ষেত্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে তার।”
অরঙ্গাবাদ ডি এন কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক সম্প্রীতি বিশ্বাস মনে করেন, “আমাদের ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। সরকারকে এই সময় ইকোনমি বুস্টারের কথা মাথায় রাখতে হবে। মানুষকে কাজ দিতে হবে, খরচ বাড়াতে হবে। লোকের হাতে পয়সা দিতে হবে। তবেই চাহিদা বাড়বে। উৎপাদনের সুযোগ বাড়বে। মুর্শিদাবাদ এমনিতেই ওভার পপুলেটেড জেলা। শুধু সরকারই সব করে দেবে সে চিন্তা ভাবনা কাটাতে হবে। যার যা সামর্থ্য সেই মতো কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এই মুহূর্তে জেলার অবস্থা খুব খারাপ ঠিকই। কিন্তু এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এর থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। কিন্তু সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যাঁরা বিত্তশালী টাকা মজুত না করে টাকাটা বাজারে ছাড়তে হবে। কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। শুধু লাভ দেখে টাকা খাটাব, অন্য সময় টাকা ধরে রাখব, সে ভাবনা থেকে সরতে হবে। কারও সামর্থ্য হয়ত ৪টি লোক খাটানো, সেটাই খাটান। ওই ৪টি পরিবারের হাতে টাকা গেলে চাহিদা বাড়বে।”
তাঁর মতে, জেলায় ফলের বাগান আছে ৩৫ হাজার হেক্টর। আমপানে ক্ষতি হয়েছে অর্ধেকটাই। বাগান মালিকেরা কিছু গাছ লাগিয়ে বাগানের পরিমাণ বাড়ালে আগামী দিনে আমপানের মতো বড় ক্ষতি সামাল দেওয়া সম্ভব। এটা যেমন বাগান মালিকের বিনিয়োগ, ঠিক তেমনই এক জন শ্রমিকের কাছে অসময়ে কাজ পাওয়ার সুযোগ।
জঙ্গিপুর কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু পালচৌধুরী বলছেন, “অন্য জেলার থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার পরিস্থিতি স্বতন্ত্র। এখানে এখন যা অবস্থা, তাতে জেলায় কাজ হারোনো মানুষের হাতে কাজ দিতে না পারলে শুধু আর্থিক সমস্যা বাড়বে তাই নয়, বড় হয়ে উঠবে সীমান্ত জেলার আইন শৃঙ্খলার প্রশ্নও। খাওয়ার অভাব হয়ত থাকবে না, কারণ রেশন ব্যবস্থায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন চাল, আটা ঢুকছে জেলায় প্রতি মাসে। কিন্তু দানধ্যান করে তো বেশি দিন চলবে না। সরকারের তরফেও যেমন চেষ্টা দরকার জব ওরিয়েন্টেড প্রকল্পগুলিকে আরও সচল করা, তেমনই যে বাগানে আম, লিচু মার খেল সেখানে এই সময় আরও বাগান সৃষ্টি, পুকুরের জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর মতো কাজে উৎসাহ দেওয়া। এতে গ্রামাঞ্চলে বহু লোক কাজ পাবেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘১০০ দিনের কাজের মজুরি বাড়িয়ে বাড়তি কাজের সৃষ্টি করতে হবে, আবাস যোজনায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। টাকা লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে ব্যাঙ্ক মাধ্যমের ব্যবহার বাড়াতে হবে যাতে ১০০ টাকার মধ্যে ১০০ শতাংশই সরাসরি শ্রমিকের হাতে যায়। সেই টাকা বাজারে এলে ফের ঘুরে দাঁড়াবে মুর্শিদাবাদ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy