Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা

চার মাস যাবৎ একই এলাকায় সমরূপ ঘটনা নিয়ত সংঘটিত হইবার ফলে এত দিনে উহা ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিয়াছে, সমাজতত্ত্বে যে প্রক্রিয়াকে ‘নর্ম্যালাইজ়েশন’ বা স্বাভাবিকীকরণ বলা যায়।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৪১
Share: Save:

নবম শ্রেণির দ্বিতীয় সেমেস্টার পরীক্ষা আর দেওয়া হয় নাই কাঁকিনাড়ার হেনা পারভিনের। ২৩ মে লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হইবার পর ঘর ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছিল হেনার পরিবার, পুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল হেনার পাঠ্য বই ও ইউনিফর্ম, হেনারা আর ঘরে ফিরিতে পারে নাই। এবং সেই সময় হইতে ব্যারাকপুর লোকসভা অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলিতেছে, তাহা থামিবার লক্ষণ নাই। রবিবারের সংঘাত এবং সোমবারের হরতাল আরও এক বার তাহা জানান দিয়াছে। হেনার মতো প্রায় সাড়ে তিনশো পড়ুয়ার পঠনপাঠন বন্ধ, সাধারণ মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা সাত। রাজ্য রাজনীতির বিরোধী পরিসরে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি ঘটিবার পর হইতেই এই দ্বৈরথের সূচনা। কিন্তু সন্ত্রাসের মুক্তাঙ্গনে রাজনীতির লাভ থাকিলেও জনতার নিশ্চিত সে লাভ নাই। তবু জাহাজের কারবারিরা সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিলে আদার ব্যাপারীদেরও নিস্তার মিলে না। সেই বিপন্নতা কোল্যাটেরাল ড্যামেজ বা সমান্তরাল ক্ষতি হিসাবে চিহ্নিত হয়।

এমন ভয়াবহ উত্তাল পরিস্থিতি বিবেকবান মানুষকে ভাবিত করিবার কথা ছিল। অথচ চার মাস যাবৎ একই এলাকায় সমরূপ ঘটনা নিয়ত সংঘটিত হইবার ফলে এত দিনে উহা ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিয়াছে, সমাজতত্ত্বে যে প্রক্রিয়াকে ‘নর্ম্যালাইজ়েশন’ বা স্বাভাবিকীকরণ বলা যায়। যে ঘৃণা এবং ক্লেদ মূলত অস্বাভাবিক, তাহার দ্বারা দীর্ঘ কাল মানুষের মনে উপর্যুপরি আঘাত হানিতে পারিলে স্বাভাবিক করিয়া তুলা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতিবার পর বহু মুক্তমনা আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন, নূতন রাজত্বে ঘৃণা ‘নিউ নর্ম্যাল’ হইয়া দাঁড়াইবে না তো? বঙ্গ-জনতাও হয়তো ভাবিয়াছে, ব্যারাকপুরে প্রাণ হাতে লইয়া চলাফেরা করাই দস্তুর! অস্বাভাবিক ক্রিয়া সংঘটিত হইলে প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া আসিয়া থাকে, কিন্তু অস্বাভাবিককেই যদি স্বাভাবিক করিয়া ফেলা যায়, তবে প্রতিক্রিয়াই বা আসে কী ভাবে? ব্যক্তিমানুষের সংবেদনশীলতা পরিস্থিতি অনুসারে তৈয়ারি হয়। গুরুত্বের ক্রমহ্রস্বতা— সংবাদমাধ্যম হইতে সমাজমাধ্যম— সর্বত্র প্রতিফলিত। স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা বদলাইয়াছে, কেহ আর রাজ্যের হিংসা পরিস্থিতি লইয়া তত ভাবিত নহে।

কিন্তু এই রাজ্য ‘রাজনৈতিক ভাবে অস্থির’ বলিয়া নাগরিক দায় সারিতে পারিলেও রাজ্যের প্রশাসনও কি তা পারে? ব্যারাকপুরের প্রসঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন উঠিবেই, প্রশ্ন উঠিবে প্রশাসনের ভূমিকা লইয়া। একই স্থলে প্রত্যহ দুই দলের রাজনৈতিক সংঘাত বাধিতেছে, নেতানেত্রীরা বিলক্ষণ অবগত, তাঁহারা চাহেন বলিয়াই বিষয়টি এত দূর গড়াইয়াছে এবং গড়াইতেছে, কিন্তু প্রশাসন সেখানে পৌঁছাইতে পারিতেছে না। কোনও কড়া বন্দোবস্ত চোখে পড়িতেছে না। প্রশাসন সক্রিয় থাকিলে, উর্দিধারীরা তৎপর হইলে সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য এত দীর্ঘ দিন গড়াইতে পারিত না। এমনকি সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের পর রাজ্যে যে প্রশাসন নাকি নড়িয়া বসিয়াছে বলিয়া শোনা যায়, সেখানেও পরিস্থিতি বদলায় না। মাঝখান হইতে কিছু মানুষের জীবন ভাসিয়া যায়। হেনা পারভিনদের লেখাপড়ার আশা উবিয়া যায়। সন্ত্রাসের স্রোত যখন এই সমাজের নূতন ‘স্বাভাবিকতা’, হেনাদের তখন আর কী-ই বা করিবার থাকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Violence TMC BJP Kankinara
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy