ফাইল ছবি।
গতকাল রাত্রে ইনস্টিটিউট থেকে ফেরার পথে আমার সাপ্তাহিক বাজারের সময়, বাঁধা মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম— অলীক, বাজেট তো আসছে। জানো? (মাছওয়ালার নাম অলীক জেনে ভারি পুলকিত হয়েছিলাম, পরে বানান করতে বলায় অবশ্য জেনেছিলাম আমার শোনার ভুল হয়েছে, কিন্তু অলীক মাছওয়ালা পাওয়ার রোম্যান্টিকতা আমাকে নামটা ত্যাগ করতে দেয় না কিছুতেই)
অলীক বলল, হ্যাঁ জানি তো। দেখা যাক কী হয়।
—কী চাইছ তুমি বাজেট থেকে?
—আমি কী চাইব দাদা, বলে অলীক, আমি চাই পাবলিকের ভাল হোক। পাবলিকের ভাল হলে আমারও তো ভাল। আর খারাপ হলে আমার আরও খারাপ। জানেন তো আমাদের অবস্থা।
ভারী অনাবিল উত্তর। সবার ভাল হলে আমার ভাল। সবার খারাপ হলে আমার আরও খারাপ।
কিন্তু তাই কি হয় আসলে! ইনকাম ট্যাক্স কমলে উচ্চ মধ্যবিত্তের যা সুবিধে, অলীক মাছওয়ালার কি সেই সুবিধে হবে? ভারতে ইনকাম ট্যাক্স দেনই তো মোট সাড়ে আট কোটির মতো মানুষ, বয়ঃপ্রাপ্ত এবং উপার্জন-সক্ষম জনসংখ্যার যা ১০ শতাংশের কাছাকাছি (তথ্য: উইকিপিডিয়া)। বাকি ৯০ শতাংশ হয় ট্যাক্স দেন না, বা ট্যাক্স দিতে তাঁদের হয় না, কারণ তাঁদের মোট আয় ট্যাক্সের আওতায় পড়ে না। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ২০১৭-র তথ্য অনুযায়ী ভারতের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নীচে। তাঁদের ক্ষেত্রে ইনকাম ট্যাক্সের প্রশ্নই তো উঠে না!
কিন্তু আরও খারাপ কেন বলল অলীক? উত্তর সহজ— দারিদ্রসীমার নীচে সে না থাকলেও, খুব বেশি উপরেও নেই। অর্থনীতিতে ঝড় এলে, প্রথমে ভেঙে পড়ে তাদের ঘর। সত্যি বলতে কি ভারতের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত এই মানুষগুলিকে দারিদ্রের গভীর খাদ থেকে টেনে তুলে আনা। সেই লক্ষ্য-পূরণের জন্য রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বোঝা যায় বাজেট থেকে।
৯০-এর দশকে অর্থনীতির দ্বার খোলে। খোলা হাওয়ার প্রকৃত ফল হয়তো আমরা দেখতে পাই পরের দশকে, যখন ২০০৬ থেকে ১৬-র মধ্যে প্রায় ২৭ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার বাইরে চলে আসেন। এখন কিন্তু অবস্থা আরও জটিল। উদারনীতি ও বিশ্বায়নের টুইন ইঞ্জিনবাহী বাহনে চড়ে ভারতের মধ্যবিত্ত সাঁ সাঁ করে ভাল থাকার রাস্তায় এগিয়ে চলেছেন। অথচ দেশের একটা বড় অংশের কাছে বিদ্যুৎ আসেনি ঠিকঠাক (গ্রাম দিয়ে একখানা বিদ্যুদ্বাহী তার চলে যাওয়া মোটেই সেই গ্রামের সবার বাড়িতে বিদ্যুৎ আসা নয়)।
সব আছে এবং কিছুই নেই শ্রেণির মধ্যে চলে আসছে কৃষ্ণ-গহ্বরের ফারাক। এটা সামান্য কমাতে গেলেও লাগবে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা, খুচখাচ খয়রাতি (যেমন ভোটের আগে দরিদ্রের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢেলে দেওয়া ইত্যাদি) দিয়ে চলবে না। সর্বজনীন প্রাথমিক আয় (Universal Basic Income বা UBI) একটি বিশ্বব্যাপী চিন্তা এখন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং দ্বারা পরিচালিত আসন্ন বিপুল যন্ত্রায়ন অনেক মানুষের চাকরি কাড়বেই, এবং সেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় জন্য ইউবিআই হয়তো একটা উপায় হতে পারে। কিন্তু ভারতের মতো বিশাল ও জটিল দেশে তার সঠিক প্রয়োগ এক দুঃস্বপ্ন। তবু আশা করব এই বাজেটে ইউবিআই নিয়ে কিছু প্রারম্ভিক চিন্তাভাবনা থাকবে।
এ বার আসি খয়রাতি না দিয়ে দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে। একজন শিশুও বলে দেবে যে— দারিদ্রের অন্ধকার দূর হতে পারে শিক্ষার আলোয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও ঠিক যে— ২০১৪-১৫ থেকে শুরু করে গত বছর অবধি বাজেটে স্কুল শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থ পর পর দু’বার কমে, তার পর বেড়ে, এখনও সেই ২০১৪-১৫-র জায়গায় আসেনি। উচ্চশিক্ষার বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে যদিও, কিন্তু শিক্ষা খাতে মোট ব্যয় এখনও সরকারি ব্যয়ের ৩.৪ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৪৫ শতাংশ (সূত্র: সেন্টার ফর বাজেট অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ বেঙ্গালুরু, সংখ্যাগুলি মূল্যবৃদ্ধি সংশোধিত)। সেখানে চিন জিডিপির ৪ শতাংশ ব্যয় করে শুধু উচ্চশিক্ষার পেছনে (মূল্যবৃদ্ধি ধরে)। উন্নত দেশগুলি করে আরও বেশি। মজার কথা হল, সরকারের নিজের তৈরি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটির দ্বারা প্রস্তাবিত নয়া খসড়া শিক্ষানীতির একটি ফরমায়েশই হল— শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশ (মূল্যবৃদ্ধি ধরে) করা ২০৩০-এর মধ্যে। সেই পথে প্রথম পদক্ষেপ কি পাওয়া যাবে এই বাজেটে?
গবেষণার পিছনে সরকারি ব্যয় না কমলেও, বাড়ছে না মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে। ভারতের অধিকাংশ গবেষকই সরকারি অনুদান (গ্ৰান্ট)-এর ওপর নির্ভরশীল। এ বার এই সরকারের একটি নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি হল ব্যক্তিগত ভাবে গবেষকদের অনুদান না দিয়ে বিষয়-ভিত্তিক অনুদান দেওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর (ডিএসটি), মানব সম্পদ উন্নয়ন দফতর (এমএইচআরডি) এ রকম বিভিন্ন স্কিম তৈরি করে, বিজ্ঞাপন দিয়ে বিজ্ঞানীদের থেকে রিসার্চ প্রপোজাল চেয়ে, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সেই প্রপোজালের গুণাগুণ বিচার করে, প্রতিযোগিতামূলক ভাবে অনুদান বিতরণ করবেন। সাধু চিন্তা সন্দেহ নেই। কিন্তু কার্যকরণের সময় দেখা গেল বিজ্ঞাপনে যেখানে বলা ছিল মোট অনুদান ৯৮০ কোটি টাকার হবে, বাস্তবে বিতরণ হল ১১২ কোটি কোটি। ৪০০ কোটি বলে আসলে ভাঁড়ার ৩০ কোটির। একটি স্কিম তো দিন দশেক আগে বাতিলই হল শেষ মুহূর্তে। নিজে গবেষক তো, স্বাভাবিক ভাবে এই বাজেটে চাইছি গবেষণায় একটু বেশি সরকারি ব্যয় তো বটেই, তা ছাড়াও অনুদান বিষয়ে সরকারের চিন্তার কিছু ডিটেলস্। ওপর ওপর চলতা হ্যয় মার্কা গা-ছাড়া কথাবার্তা না।
আর চাইছি সততা। স্বীকার করা যে ‘অচ্ছে দিন’ আমরা কাটাচ্ছি না। অর্থনীতি ক্রমশ যেন তৈলাক্ত বাঁশে চড়ে হু হু করে নীচের দিকে নেমে চলেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হল যে, সকলেই যেন উদ্বিগ্ন সরকার ছাড়া। তাঁরা বিভিন্ন সংখ্যাতত্ত্বের প্যাঁচ মেরে বুঝিয়ে চলেছেন সব ঠিক হ্যায়। এই পতন একেবারেই স্বল্প মেয়াদী। অথচ বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ক্রেতা-ব্যয় সূচক চার দশকে এই প্রথমবার নিম্নগামী। মানুষ ব্যয় করতে চাইছেন না। বিনিয়োগেও ভয় পাচ্ছেন। তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে, এই বছরে গত দুই দশকের মধ্যে প্রথমবার দেখা যাচ্ছে বড়সড় ঘাটতি। কী করে বাড়বে সরকারি আয়?
সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানি দিয়ে কি দায় এড়ানো যায়! এফসিআই-এর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে সরকারি খাতা থেকে সেই হিসেব বাদ দিয়ে মোট আর্থিক ঘাটতিকে বাগে আনলে অঙ্ক মেলানো যায়, কিন্তু বদলায় কি কিছু? এর ফলে কিন্তু কোথাও গিয়ে আস্থা টলছে। আর এই আস্থার খামতিই কিন্তু বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে যা আর্থিক বৃদ্ধির সহায়ক একেবারেই নয়।
সম্প্রতি আইসার (কলকাতা)-য় অনুষ্ঠিত একটি কনফারেন্সে নতুন একটা শব্দ শুনলাম: ভুকা (VUCA, Volatile Uncertain Complex Ambiguous)। অ্যাক্রোনিম। বাংলা করলে হয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল, অনিশ্চিত , জটিল, দ্ব্যর্থক। সিএএ এবং এনআরসি-তে আক্রান্ত আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে বলা যেতেই পারে ভুকা-সুলভ। আর তার সঙ্গে রয়েছে কুড়ি শতাংশেরও বেশি ভুখা মানুষ।
ভুকা-হাল মানুষের দেশের ভুখা মানুষগুলোকে নতুন কোনও স্বপ্ন দেখাবে বাজেট? নাকি সেটা আশা করা অলীক কল্পনা মাত্র!
(লেখক আইসার-কলকাতার পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy