সুপ্রিম কোর্ট বলিল, হাতির চলিবার পথ নির্বিঘ্ন করিতে মানুষ বাধ্য। তামিলনাড়ুর বাইশ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘নীলগিরি এলিফ্যান্ট করিডর’ অন্তত নয়শত হাতির পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালা অঞ্চলের মধ্যবর্তী চলাচলের পথ, কিন্তু মানুষের ‘আক্রমণ’-এ সেই পথ ও পথিক দুই-ই বিপন্ন হইয়াছে। পাহাড় অরণ্য কথা কহিতে পারে না, হাতি বিরাট ও বলশালী হইলেও সভ্য মানুষের কূট বুদ্ধি ও প্রযুক্তির নিকট পর্যুদস্ত, অতএব হাতির চলিবার পথ যে মানুষ দখল করিয়া লইবে, আশ্চর্য কী। অরণ্যচারী আদিবাসী ও জনজাতি মানুষের কথা আলাদা, বন্য প্রাণীর সহিত সহাবস্থানের শিক্ষা ও শিল্প তাঁহাদের অন্তঃস্থ। তাঁহারা ভিন্ন অন্য মানুষ গাছ কাটিয়া বসত গড়ে, চা-বাগান ও কৃষিক্ষেত্র প্রস্তুত করে, ক্লান্ত বিশ্রামার্থী শহরবাসীর দুই দণ্ড নিভৃতির স্বার্থে হোটেল-অতিথিশালা বানায়। বাস্তুভিটা হইতে উচ্ছেদ হইলে মানুষ অন্যত্র বাসস্থান গড়ে, ক্রমসঙ্কুচিত অরণ্য হইতে হাতিরা উচ্ছেদ হইলে কোথায় যাইবে? কিছু হোটেলের মালিক যুক্তি দিয়াছিলেন, হাতিদের সহিত তাঁহারাও দিব্য রহিয়াছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শরদ বোবডে শুনিয়া মন্তব্য করিয়াছেন, তাহার কারণ হাতিরা ‘ভদ্রলোক’, মানুষের কী দরকার পড়িয়াছে অরণ্যের গভীরে যাইবার?
তামিলনাড়ুর ব্যাপার, বলিয়া উড়াইয়া দিবার যুক্তি টিকিবে না। পশ্চিমবঙ্গবাসীর জানা উচিত, দেশ জুড়িয়া চিহ্নিত প্রায় ৮৮টি ‘এলিফ্যান্ট করিডর’-এর মধ্যে এই রাজ্যে তথা উত্তরবঙ্গেই রহিয়াছে ১৪টি, এবং অঞ্চল বা ‘জ়োন’ হিসাবে ভাগ করিলে সর্বাধিক সংখ্যক ‘করিডর’ও উত্তরবঙ্গেই— হাতিদের বসবাস রহিয়াছে এমন প্রতি ১৫৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা অতিক্রম করিলেই একটি করিয়া ‘করিডর’। মানুষের জন্য না হউক, হাতিদের জন্য— বিশেষত এশীয় প্রজাতির হাতি, সারা বিশ্বে এই প্রজাতির সংখ্যা যত তাহার প্রায় অর্ধাংশেরই বাস এই দেশে— বিস্তৃত, অখণ্ড ও নিরুপদ্রব অরণ্য ও অরণ্যপথ কত প্রয়োজনীয়, বলিবার অপেক্ষা রাখে না। সমীক্ষা বলিতেছে, ভারতে হাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির মধ্যে উত্তরবঙ্গের অবস্থাই সবচেয়ে করুণ। প্রায়শই অরণ্যের মধ্য দিয়া চলিয়া যাওয়া রেললাইনে কাটা পড়া হাতির রক্তাক্ত শরীর সংবাদ শিরোনাম হয়। উত্তরবঙ্গে বা বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার গ্রামে হাতি আসিয়া পড়িলে মানুষ উত্তেজিত হইয়া উঠে। আসলে হাতি নহে, মানুষই যে অপরাধী, মানুষই যে হাতির স্বাভাবিক বাসভূমির মধ্যে অনুপ্রবেশ না হউক অনধিকার প্রবেশ করিয়াছে, ‘হাতি খেদানো’র আগুন বা কানেস্তারার সম্মুখে সেই কথাটি লুকাইয়া পড়ে।
কেহ বলিতে পারেন, এই কালে মানুষই চলিবার পথ পায় না, হাতি কোন ছার। কথা তাহা নহে। অরণ্য ও বন্যপ্রাণীকে রক্ষার জন্য সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু নীতি আবশ্যক। সরকার তাহাদের কেবল সম্পত্তি ভাবিলে রক্ষণকে ছাপাইয়া ভক্ষণের ইচ্ছাই জোরদার হয়। অরণ্যকে অরণ্যই থাকিতে দিতে হইবে। বন্যপ্রাণীর বাসভূমি ও চলিবার পথ বলিয়া যাহা চিহ্নিত, তাহা বাঁচাইয়া রেল, সড়কপথ, কৃষিক্ষেত্র গড়িবার কাজ কঠিন হইতে পারে, অসম্ভব নহে। জাতীয় ‘এলিফ্যান্ট করিডর’ প্রকল্পের অধীনে কেরল সরকার জনবসতি সরাইয়া হাতিদের চলিবার পথ মসৃণ ও প্রশস্ত করিয়াছে। বাংলা ভাবিয়া দেখিবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy