আর ক’টা দিন অপেক্ষা করলে অতনু মিস্ত্রি অন্তত দেখে যেতে পারতেন, তাঁর চাকরি না পাওয়ার অবসাদ আর অন্যদের চাকরি পাওয়ার পর তা টিকিয়ে রাখতে পারা-না-পারার অবসাদ, একই মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। আর সেই কারণেই এ বছর মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের (১০ অক্টোবর) বিষয় রাখা হয়েছিল ‘মেন্টাল হেলথ ইন ওয়ার্কপ্লেস’।
অতনু ইংরেজিতে এম এ। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও একটা শিক্ষকতার কাজ জোটাতে পারেননি সোনারপুরের এই তরুণ। শেষে একটা ইন্টারভিউতে হাউজকিপিং তথা ‘ঘর মোছা’র চাকরি পেয়ে, বাড়ি ফিরে এসে, গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে, দেহ-মন সবসুদ্ধু নিয়ে ঝুলে পড়েন। গত অগস্ট মাসে।
এ বছর ‘মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’-এর জানা গেল নানান কাহিনি। তার একটি মার্কিন দেশের। ২৯ বছরের টমাস চাকরির জায়গায় চাপ সামলাতে না পেরে, সকাল দশটা নাগাদ, শশব্যস্ত অফিস আওয়ারে, ম্যানহাটানে তাঁর ২৪ তলার ফ্ল্যাট থেকে ঝাঁপ মেরে আত্মঘাতী হন কিছু দিন আগে।
দীর্ঘদিন ‘কাজ’ না পাওয়ার একটানা অবসাদ, আর কাজ পেয়েও যে কোনও সময় তা ফসকে যাওয়ার আতঙ্ক— কোনটা কতটা আত্মঘাতী, বলা মুশকিল। তবে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’য় বসে, সনাতন বারাণসীর ‘স্মার্ট সিটি’ হওয়া দেখতে-দেখতে কোন ফাঁকে যেন চোখ চলে যায় ‘মণিকর্ণিকা’র দিকে। এ দেশে কর্মহীনতার কারণে প্রতি বছর প্রায় ৪৫,০০০ আত্মহননের যে পর্ব চলে, তার কিছু না কিছু অনিঃশেষ নাভিমূল, যেন মনে হয়, মণিকর্ণিকা অভিমুখে এগিয়ে যায়, ভাসতে-ভাসতে। আর সেই দগ্ধ চিতাভস্মের প্রতিটা কণায় ঢুকে পড়ে কৃষক, কৃষি-ঋণ, বেকারত্ব, কাজ হারানোর ভয়, আত্মঘাত, বিদর্ভ, অন্ধ্র, পশ্চিমবঙ্গ, সোনারপুর, অতনু মিস্ত্রি।
পুরো বিষয়টাকে সংহত করলে দাঁড়ায়: অর্থনৈতিক কারণে আত্মহত্যা। অতএব, তার অনুষঙ্গ জুড়ে অন্ধ্র, বিদর্ভ-র সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়বে শহর-মফস্সলের সেই সব পরিবার, যারা ক্রেডিট কার্ডের ধার শুধতে না পেরে ফুটফুটে শিশু-সহ সপরিবার আত্মহত্যা করে থাকে মাঝেমধ্যেই। এসে পড়বে বন্ধ কলকারখানা, বদ্ধ বেঁচে থাকা, রুদ্ধ রুজিরোজগারজনিত আত্মঘাত। সোনারপুর, অতনু মিস্ত্রি পার হয়ে এসে পড়বে ম্যানহাটানের চব্বিশ তলা। শূন্য থেকে মহাশূন্যে উল্লম্ফন।
কর্ম, কর্মহীনতা, আত্মঘাত, অপঘাত— এক বিশ্বায়িত মণিকর্ণিকার ঘাটে, কখন যেন ও দেশ থেকে এ দেশের পথে চলে আসেন বাইশ বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ গুপ্তা। সান ফ্রানসিসকোয় এক বহুতলের পার্কিংলটে যাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওপরের দিকে চেয়ে দেখা যায় আত্মঘাতী খোলা জানালা। মৃতের বাবা সুনীল গুপ্তা লেখেন: ‘আ সন নেভার ডাইজ’, আর আত্মঘাতীর ভাষ্যে ফুটে ওঠে আত্মঘাতের কারণ: দু’রাত ধরে ঘুমোতে পারিনি। কাল সকালে আবার ক্লায়েন্ট মিটিং। এর মধ্যে প্রেজেন্টেশনটা কমপ্লিট করতে হবে। আমার ভিপি খুব চিন্তিত। গোটা অফিসে একা বসে কাজ করে চলেছি আমি’।
মৃত্যু যখন নির্মম থেকে নির্মমতর হয়ে ওঠে চোখের সামনে, কাজ না পাওয়ার অবসাদে, কাজ পেয়েও তা খোয়ানোর আশঙ্কায়, তখন স্রেফ চুটিয়ে মজা করতে ইচ্ছে করে। যেমনটা করেছিলেন চার্লস চ্যাপলিন, তাঁর ‘মডার্ন টাইমস’-এ। কাজের ফাঁকে টয়লেটে গিয়ে দু’দণ্ড বেশি সময় নেওয়ায়, দেওয়াল জোড়া জায়ান্ট স্ক্রিন থেকে বসের বেধড়ক ধমক খেতে হয় তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেতে হয় মেশিনের কাছে। মেশিনে কাজ করতে করতে আরও সব মেশিনেরা এসে পড়ে। লাঞ্চব্রেকে যাতে সময় নষ্ট না হয়, তাই যন্ত্রচালিত উপায়ে কর্মচারীদের মুখে খাবার গিলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্প-সভ্যতার সেই উষালগ্নে কাজ করতে করতে মানসিক ভারসাম্য হারান চ্যাপলিন। এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মানসিক হাসপাতালের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যায় তাঁকে। মেশিনের মধ্যে দলামোচড়া হয়ে আমাদের ‘মডার্ন টাইসম’-এর এক ধ্রুপদী প্রতীক হয়ে ওঠেন চ্যাপলিন। প্রায় আশি বছর আগের ‘মডার্ন টাইমস’ হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয়: ‘মেন্টাল হেলথ ইন ওয়ার্কপ্লেস’ কাহাকে বলে।
আর তারই প্রচ্ছায়া খবরের কাগজের ছবিতে: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন রোবটের সঙ্গে করমর্দন করছেন। কাজের জায়গায় মানুষের হাতের কাজ অনেকটাই করে দেবে ওই রোবট: আবেদনপত্র ভরতি, টাকা লেনদেন, অনেক কিছুই। স্টিরিয়োটাইপ থেকে বুদ্ধিটাইপ— অনেক কাজই এ বার করবে মেশিন। আগের চেয়ে অনেক বেশি। তাই খবরের কাগজের পাতায় দেখি, মেশিনের কোপে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি ছাঁটাই। ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’য় পরিসংখ্যানের ডিজিট মসৃণভাবে জানিয়ে দেয় ‘যান্ত্রিক’ কারণে ছাঁটাইয়ের খবর।
অতএব মনে হয়, চাকরি পাব কি পাব না, পেলেও সে চাকরি ক’দিন ধরে রাখতে পারব—
এহেন দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস, ডিপ্রেশন— এ বার তো সবই তামাদি হয়ে যাবে। এবং এক দিক থেকে ভালই হবে। ‘সেল্ফ কাউন্সেলিং’ করে নিজেদের অন্তত বলতে পারব: চাকরিই নেই তো আর ডিপ্রেশন কিসের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy