Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

নামভূমিকায়

স্বল্পবাক, মৃদুভাষী। মিশুকেও নন। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘সফল’ বলাও মুশকিল। তবু রাজনৈতিক বোধের জোরেই মহারাষ্ট্রের ভাগ্যনিয়ন্তা পদের অন্যতম দাবিদার উদ্ধব মহারাষ্ট্র নির্বাচনে দেবেন্দ্র ফডণবীস, শরদ পওয়ার, পৃথ্বীরাজ চহ্বাণদের নাম ছিল আলোচনায়, কে কতটা জাল বিস্তার করবেন চলেছিল সেই জল্পনা।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৬
Share: Save:

ইন্দিরা গাঁধীর কথা মনে পড়তেও পারে। হাজার হোক, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নেতৃপদের ব্যাপার। নেহরু কুর্সিতে, আর তাঁর মেয়ে শিক্ষানবিশি ঢঙে রাজনীতির চেষ্টায় রত। সংসদ ভবনে অপদস্থও হচ্ছেন। নাম জুটছে ‘গুঙ্গে গুড়িয়া’। এই নির্বাক পুতুলই প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অকালমৃত্যুর পর একাধিক দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেস নেতাকে পেরিয়ে কেবল প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠলেন না, কড়া হাতে দেশ শাসন করে ‘লৌহমানবী’র তকমাও জোগাড় করে ফেললেন। সবার অলক্ষ্যে ‘মাতোশ্রী’তে যিনি ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে উঠলেন, তাঁকে দেখে সে সব কথা মনে পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। ভারতীয় রাজনীতির আর এক ‘সফল’ স্টারকিড— উদ্ধব ঠাকরে।

মহারাষ্ট্র নির্বাচনে দেবেন্দ্র ফডণবীস, শরদ পওয়ার, পৃথ্বীরাজ চহ্বাণদের নাম ছিল আলোচনায়, কে কতটা জাল বিস্তার করবেন চলেছিল সেই জল্পনা। সেই তুলনায় বিজেপির ছোট শরিক উদ্ধবের মুখে আলো কিছু কমই পড়েছিল। ভোটে তারা যা ফল করেছিল, তাতে সরকার না হওয়ারও কারণ ছিল না। সহজেই ম্যাজিক ফিগার পার, কেন্দ্রেও জোট। এমতাবস্থায় মাঠে নামেন উদ্ধব, বিজেপিকে বিস্তর ঝামেলাতেও ফেলেন।

শেষ অবধি যে সফলতা পেলেন না, তার কারণটাও কি তাঁর নিজের রাজনীতিতেই নিহিত? যে ধরনের সুযোগভিত্তিক রাজনীতি করে আসছেন উদ্ধব ঠাকরে, তাতে নাক ঘষে যাওয়ার আশঙ্কা তো থাকেই। সংখ্যার দর-কষাকষির খেলা এমনিতেই বিপজ্জনক। তার ওপর প্রতিপক্ষ অমিত শাহের মতো মহা-কৌশলী। এবং, উদ্ধব ভরসা করতে শুরু করেছেন যে শরদ পওয়ারের ওপর, তাঁর পরম মিত্রও বলবেন না যে তিনি আস্থাভাজন। যে পিচ্ছিল পথে হেঁটে লক্ষ্যে পৌঁছবেন বলে ভেবেছিলেন উদ্ধব, সেই পথই হয়তো তাঁকে ঠেলা মেরে ফেলে দিল।

বিজেপির রাজনীতির পালেই বরাবর মৃদুমন্দ পবনের জোগান দিয়েছে শিবসেনা। তাতে ফেঁপে উঠেছেন মোদী-শাহ। ক্রমে জমি হারিয়েছেন ঠাকরেরা। ছেড়ে দেননি উদ্ধব। সমানে টক্কর দিয়ে গিয়েছেন। পূর্বতন বিজেপি সরকারকে বার বার অপদস্থ করেছেন। চাপ বাড়ানোর কৌশল বার করেছেন। নির্বাচনের পর তার জোরেই মুখ্যমন্ত্রী আসনের চৌকাঠ অবধি পৌঁছেছিলেন। শেষ মুহূর্তে অবশ্য কাকভোরে রাজভবনে ঘটল অন্য নাটক।

রাজনীতি এক অনন্ত সম্ভাবনার খেলা। এই সারসত্য যিনি যত ভাল হৃদয়ঙ্গম করেন, তাঁর কেরিয়ারগ্রাফে ততই উন্নতি। উদ্ধব মহারাষ্ট্রের জটিল পাটিগণিত মিলিয়েছেন সেই চালেই। ১৯৯০ থেকে দলের উত্তরাধিকার নিয়ে খুড়তুতো ভাই রাজের সঙ্গে প্রবল ঠোকাঠুকি। রাজের পাল্লা ভারী— জেলায় সফর করেন, বক্তৃতায় আগুন ঝরান, মিছিলে কাঁপান মরাঠাভূম। এ দিকে ‘দাদু’ (রাজের দেওয়া নাম) উদ্ধব মিতভাষী, অ-মিশুকে। কিন্তু তবু কী ভাবে যেন উদ্ধব মানুষের মনে জায়গা করে নিতেন। পাকা খেলোয়াড়ের বুদ্ধিটাও ছিল। তেমন এক চালেই ২০০৫-এ রাজকে আলাদা দল গড়তে বাধ্য করেন। পারিবারিক অঙ্কও উদ্ধবের পক্ষে যায়। ২০১২-র শেষ জনসভায় উদ্ধব ও উদ্ধব-পুত্র আদিত্যের প্রতি বিশ্বাস রাখার অনুরোধ জানান বালাসাহেব।

ঘর থেকে বেরিয়েও নিজের মতো করে ঘুঁটি সাজাতে থাকেন উদ্ধব। মুখ্যমন্ত্রিত্বের বাসনায় প্রথম বার ভোটে লড়িয়ে দেন ঠাকরে বংশের আদিত্যকে। বাবার ‘ডায়ার্কি’ বা দুই ক্ষমতাকেন্দ্রের নীতি পরিহার করেন। ছুৎমার্গ রাখেন না কংগ্রেস বা এনসিপি সম্পর্কে। দু‌ই পওয়ারের এনসিপি এবং বহু নেতা ও হাইকম্যান্ডের কংগ্রেসের সঙ্গে হিসেব বুঝে খেলা চালান। এই ‘শিবসৈনিক’-এর দৃঢ়তা, বাগ্মিতা, ক্যারিশমা, সবই আছে, আর আছে নতুন করে ভাবার সাহস। যা দিয়ে কট্টর মরাঠি ও হিন্দুত্ববাদী দলকেও তিনি তুলে ধরেছেন বৌদ্ধ দলিত আর হিন্দিভাষীদের অঙ্গনে। আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচিতির রাজনীতির নিগড় ভেঙে শিবসেনার আজেন্ডায় ঢুকিয়েছেন কৃষি-সঙ্কট।

রাজনীতিকের দরকার ধূর্ততা। পরিবারের ভেতরে আন্ডারডগ হয়েও সবাইকে টপকে শীর্ষপদটি দখল করেছিলেন, আবার সবাইকে চমকে দিয়ে মহারাষ্ট্রের রাজনীতির প্রথম নেতাদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন কার্টুনিস্ট থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা উদ্ধব। বোধ হয় তাঁর জন্যই অমিত শাহের কলকাতার দিনরাতের ম্যাচটা মিস হয়ে গেল!

শোনা যায়, ১৯৯৭ সালে নাকি এক বার রাজের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে উদ্ধব পড়ে যাওয়ায় সবাই খুব হেসেছিল। ব্যস, পর দিন থেকে মাঠে যাওয়া বন্ধ। অভিমানে নয়, খেলা শিখতে। শিখেও ছাড়েন।

এ বারের দান ফস্কে গেল। তবে উদ্ধব তো নিজেকে বলেন ‘কচ্ছপ’। ধীর এবং অবিচলিত। দেখা যাক।

অন্য বিষয়গুলি:

Maharashtra Uddhav Thackeray Shiv Sena
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy