Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
আমাদের সন্ধেপুজো
TV Serial

বাংলা সিরিয়াল, লিঙ্গ রাজনীতি ও প্রতিবাদী মহিলা দর্শক

সিরিয়ালের চরিত্রগুলোর সঙ্গে তাঁদের এমন এক একাত্মতা জন্মে যায় যে, চরিত্রগুলোই হয়ে ওঠে ঘরের লোক, কাছের মানুষ।

ছবি: শুভেন্দু চাকী

ছবি: শুভেন্দু চাকী

অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২০ ০৩:৩৯
Share: Save:

আজকের দিনে বাঙালি মহিলাদের অবসর যাপনের অন্যতম সঙ্গী হল টিভি-সিরিয়াল। পেশা, বয়স, শিক্ষাগত মান নির্বিশেষে তাঁরা সিরিয়ালের প্রতি আসক্ত। ছাপা অক্ষরের থেকেও তাঁদের বেশি টান টেলিভিশনে বলা গল্পের প্রতি। শুধুমাত্র টিভির পর্দায় নয়, অনলাইনেও তাঁরা পছন্দের সিরিয়ালের স্বাদ নেন। পুরুষদের যে সিরিয়ালে ঘোরতর অরুচি তা নয়, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, সিরিয়ালের সিংহভাগ দর্শক মেয়েরাই। সিরিয়ালের চরিত্রগুলোর সঙ্গে তাঁদের এমন এক একাত্মতা জন্মে যায় যে, চরিত্রগুলোই হয়ে ওঠে ঘরের লোক, কাছের মানুষ। কান্না-হাসির দোলায় দুলতে দুলতে সিরিয়ালের চরিত্রদের জীবন আর দর্শকদের জীবন পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে বছরের পর বছর ধরে এগিয়ে চলে।

তবে সিরিয়ালে যা দেখানো হয়, তার ষোলো আনাই কি গ্রহণ করেন মহিলা দর্শকরা? অর্থাৎ, বিনোদনের নামে যে সুখাদ্য বা কুখাদ্য পরিবেশন করা হয়, তা-ই কি হাসিমুখে গলাধঃকরণ করেন তাঁরা? ইদানীং কালের সিরিয়ালে এক জন পুরুষের বিনা ডিভোর্সে দ্বিতীয় বিয়ে, দুই বৌ নিয়ে এক ছাদের তলায় সহাবস্থান, এই সব আইনত অবৈধ ঘটনার ছড়াছড়ি। প্রেম আর প্রেমহীন দাম্পত্যের টানাপড়েন তো আছেই।

কিছু দিন আগে কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে সিরিয়াল-আসক্তি কতটা গভীর, সিরিয়ালের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাঁদের কী মতামত, তা বোঝার জন্য একটি ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছিলাম। যাঁরা উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বয়স, শিক্ষাগত মান ও আয়ের লক্ষণীয় তারতম্য ছিল। আমার সমীক্ষা প্রমাণ করেছিল যে— শহুরে, উচ্চশিক্ষিত, কর্মজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত মহিলারাও বিনোদনের উদ্দেশ্যে, সারা দিনের পরিশ্রমের পর মনকে একটু হালকা করার জন্য সিরিয়াল দেখেন। সিরিয়াল শুধুমাত্র শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা গৃহবধূদের মনোরঞ্জনের বিষয়— এই মিথটাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল আমার সমীক্ষা।

সমীক্ষা থেকে জানতে পেরেছি যে, মেয়েদের সিরিয়াল আসক্তি অন্ধ নয়। প্রায় নব্বই শতাংশ উত্তরদাতাই জানিয়েছেন, তাঁরা সিরিয়ালে দেখানো বহুগামিতা ও বহুবিবাহকে সমর্থন করেন না। আমার সমীক্ষা ইঙ্গিত করে, মেয়েরা সচেতন, বিশ্লেষণী ক্ষমতাসম্পন্ন দর্শক। তাঁরা জানেন কী চান। অবশ্য অপছন্দের বা আপত্তির দিকগুলো নিয়ে সিরিয়াল-নির্মাতা বা চ্যানেলের কাছে নিজেদের মতামত পৌঁছে দেওয়ার কোনও চেষ্টা তাঁরা করেননি। বলেননি, এ সব দেখব না, সিরিয়াল বয়কট করব। আর এই তেজটাই সম্প্রতি কয়েকটি জনপ্রিয় সিরিয়ালের দর্শকেরা দেখাচ্ছেন।

প্রথম যে সিরিয়ালের গল্পবিন্যাস নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল, সেটি বেশ সুন্দর ভাবেই এগোচ্ছিল। ডাক্তারির ছাত্রী নায়িকা আগেই উপলব্ধি করেছে বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার নায়কের প্রতি তার অনুভূতি এবং ভালবাসার কথা স্পষ্ট ভাষায় জানাতে একটুও দ্বিধা হয়নি। নায়িকার নিঃসঙ্কোচ প্রেম নিবেদন দর্শকদের মন কেড়েছিল। প্রেমের সম্পর্কে মেয়েরা কেন নিষ্ক্রিয় থাকবে? মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, এই ছাঁচবদ্ধ ধারণাটায় সজোরে আঘাত করেছিল এই গল্পের নায়িকা। নায়কের ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস নেই। তা সত্ত্বেও সে ভালবেসেছে। এ দিকে যখন নায়ক তার ভালবাসার কথা জানাতে গেল, তখন তার প্রিয়তমা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আসলে নায়িকা জানতে পেরেছিল যে, সে এক মারণ রোগে আক্রান্ত। তাই সে তার ভালবাসার মানুষকে দুঃখ দিতে চায় না।

ইতিমধ্যে কোভিড-জনিত পরিস্থিতির কারণে সিরিয়ালের নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করা জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাময়িক অব্যাহতি নিলেন এবং আর এক জন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নিযুক্ত হলেন। কিন্তু, দর্শক চান আগের নায়িকা ফিরে আসুন। নায়িকাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সমাজমাধ্যমে যে ঝড় উঠল, তা বাংলা টেলিভিশনের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। নায়িকা ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু তত দিনে অন্য অভিনেত্রীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গল্পের ট্র্যাক ঘুরে গিয়েছে। শুরু হয়েছে এক জন প্রতিষ্ঠিত মহিলা চিকিৎসকের অবিশ্বাস্য অসহায়তার গল্প। তার প্রেমিক আসলে এক সাইকোপ্যাথ, যার হাত থেকে বাঁচতে সে বিয়ের আসর ছেড়ে, নিজের শহর ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে তার প্রেমিকের মেয়ে এবং মাকে। এখানেও দিন-রাত সেই অসুস্থ পুরুষ তাকে তাড়া করে বেড়ায়, সে ঘন ঘন মূর্ছা যায়, অথচ পুলিশে খবর দেয় না।

এই রকম এক সুপ্রতিষ্ঠিত সফল মহিলার অসহায়তা দেখতে নারাজ দর্শকেরা। উল্লেখ্য, এঁদের প্রায় ৯৯ ভাগই মহিলা। বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, এবং অবশিষ্ট মহিলা দর্শকদের একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত ও বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত। অন্তত এই সিরিয়ালকে কেন্দ্র করে সমাজমাধ্যমে অজস্র ফ্যান পেজ-এর সদস্যদের প্রোফাইল দেখে এই ধারণাই হয়। দর্শকেরা তা-ও এক রকম সয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু যখন সাইকোপ্যাথের হুমকির মুখে পড়ে এই মহিলার পালিত মেয়েকে রক্ষা করার জন্য নায়ক বিয়ের প্রস্তাব দিল, তখন আবার সমাজমাধ্যমে ঝড়। প্রথমত, নায়িকা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে তাঁরা নায়কের বিয়ে মেনে নেবেন না। দ্বিতীয়ত, তাঁরা প্রশ্ন করলেন, এক জন আত্মনির্ভর মহিলার ক্ষেত্রে বিয়ে কেন হবে রক্ষাকবচ? এই নারী-ক্ষমতায়নের যুগে এক জন মহিলা চিকিৎসকের দুর্বল, অসহায়, প্রতিবাদে অক্ষম, পুরুষ-নির্ভর অস্তিত্বকে মেনে নিতে চাইলেন না তাঁরা। অগত্যা, ঘুরিয়ে বলা হল বিয়েটা নকল। কিন্তু, ভক্তেরা সেই নকল বিয়েও মানতে রাজি নন। ভালবাসবে এক জনকে, আর বিয়ে-বিয়ে খেলবে আর এক জনের সঙ্গে? বিবাহ প্রতিষ্ঠান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা তাঁরা সইবেন না, সাফ জানালেন। দর্শকদের শান্ত করতে তাড়াহুড়ো করে হারিয়ে যাওয়া নায়িকাকে ফেরত আনা হল এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে নায়কের সঙ্গে তার গোপনে বিয়ে সাঙ্গ হল। এর পর গল্পে অন্য মহিলা চরিত্রটির প্রাধান্য বজায় রাখতে তাকে ড্রাগের প্রভাবে বিকারগ্রস্ত করে দেওয়া হল। নানা ভাবে সে নায়ককে নিজের কাছে টানতে চায়। আবার ঝড়। সমাজমাধ্যমকে হাতিয়ার করে দর্শকেরা জানালেন, তাঁরা নায়ক-নায়িকার একসঙ্গে পথচলা দেখতে চান, পতি-পত্নী আর তৃতীয় ব্যক্তির কিস্সা নয়।

প্রতিবাদের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে অন্য সব সিরিয়ালের দর্শকদের মধ্যেও। আর এক জনপ্রিয় সিরিয়ালের অধ্যাপক নায়কের সঙ্গে ছাত্রীর প্রেম। তবে সেই প্রেম নিষ্কণ্টক নয়। নায়ক-নায়িকা মন্দিরে গোপনে বিয়ে সেরে ফেললেও প্রবল আশঙ্কা, পরিবারের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে নায়কের বিয়েটা আটকানো যাবে না। কিন্তু, দর্শকেরা এত দিনে বুঝেছেন, মুখ বুজে মানলে চলবে না। ইতিমধ্যেই তাঁরা প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। তাঁরা চান প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পরের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য দেখতে।

লক্ষণীয়, এখনও বয়স-নির্বিশেষে মহিলাদের মনোজগতে বি-সমকামী (heterosexual) প্রেম এবং সেই প্রেমের সফল ও চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বিবাহ স্বীকৃত এবং পূজিত। তাঁদের নৈতিক বিশ্বে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির অবিসংবাদিত সার্বভৌমত্ব। তবে প্রেমহীন বিবাহ তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বি-বিবাহ, নামমাত্র বিবাহ, নকল বিবাহ, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, বহুগামিতা— এতে তাঁদের যে রুচি নেই, সে কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছে সিরিয়ালের ভক্তকুল। বেশির ভাগ সিরিয়ালের নায়িকাই সদ্য সাবালক হওয়া ছাত্রী। আর তার প্রেমিক বা স্বামী তার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়, উচ্চপ্রতিষ্ঠিত। প্রেমের সঙ্গে মিশে গিয়েছে শাসন। বিয়ের পরে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতায় সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। এই ব্যাপারে অবশ্য দর্শকদের বিশেষ আপত্তি নেই।

সিরিয়ালে প্রেম, দাম্পত্য, পারিবারিক সম্পর্কের চিত্রণ সম্বন্ধে সিরিয়াল নির্মাতাদের এ বার গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সিরিয়াল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গণমাধ্যম। পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শের আধিপত্যকে আরও বলীয়ান করতে পারে, একই সঙ্গে তাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে। অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অন্তর্লীন লিঙ্গ রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিতে পারে, আবার তা রুখতেও পারে। আর মহিলা দর্শকেরা ইতিবাচক ভূমিকাতেই দেখতে চান তাঁদের প্রিয় ধারাবাহিকগুলিকে।

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার উইমেন্স ইউনিভার্সিটি

অন্য বিষয়গুলি:

TV Serial Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy