কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কীরে বিয়ে করছিস না কেন? সে উত্তরে বলেছিল, ‘‘বড়দার বিয়ে দিয়ে যা ঘটল, তাতে আমার বিয়ের শখ মিটে গিয়েছে।’’
পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি গার্হস্থ্য হিংসা আইনের ৪৯৮ ধারার অপব্যবহার তাদের পুরো পরিবারকে পথে নামিয়ে আনে। এমন উদাহরণ এ দেশে ভুরি ভুরি। কিন্তু তাই বলে বধূনির্যাতনের বিরুদ্ধে এই ধারার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়? ঠিক একই যুক্তিতে স্বীকার করতেই হবে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের মতো একটা জঘন্য হঠকারিতার বিরুদ্ধে কড়া আইনের আবশ্যিকতা। কিন্তু বিষয়টি যখন আইনগত, বিশেষ করে সেটা যদি হয় ফৌজদারি, তা হলে তো তা জারির আগে ভাবনা আরও বেশি করে প্রয়োজন ছিল।
যে তিন তালাক বিল ৩০ জুলাই রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গেল, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন তা আমাদের সামনে অনেকগুলি প্রশ্ন তুলে ধরে। কারণ, ওই বিলে তিন তালাককে দেওয়া হয়েছে ফৌজদারি তকমা। অবশ্য সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের বুঝে নেওয়া জরুরি— যে তিন তালাক নিয়ে এত কাণ্ড তার কি কোনও সমর্থন আদৌ কোরান তথা ইসলামে আছে? ইসলাম তালাক অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদকে পৃথিবীর সব চেয়ে জঘন্য ও গর্হিত কাজ বলে মনে করে। কোরান সাক্ষ্য— “তালাকে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।’’ কিন্তু বাস্তবে বিবাহবিচ্ছেদ কখনও অনিবার্য হয়ে উঠলে ইসলাম তার বিধান দিয়েছে। ইসলাম কী বলছে তালাক নিয়ে? সে এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। এতটাই দীর্ঘমেয়াদী ও জটিল নিয়মনীতির নিগড়ে বাঁধা যে ক্ষণিকের ক্রোধবশত তা সম্ভব নয়। বরং যে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার কথা ইসলাম বলে তাতে তালাক অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ হওয়াই কঠিন। আসলে এই জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা দু’টি মানব-হৃদয়ের সংশোধন, সহিষ্ণুতা ও আত্মোপলব্ধির সুযোগ করে দেয়।
প্রথমেই বলি, ক্ষণিকের ক্রোধে তালাক বললেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় না। তালাক দেওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী একই বাড়িতে কমপক্ষে তিন মাস থাকবে। এই সময়ের মধ্যে তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সুলভ কোনও সম্পর্ক তৈরি হলে তালাক গ্রাহ্য হবে না। যদি তা না হয় তবেই তারা ইদ্দত (অর্থাৎ সংশোধনের জন্য অপেক্ষা কাল) পেরিয়ে গিয়েছে ধরে নেওয়া হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইসলাম সংশোধন ও আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে সম্পর্কের পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী এবং তার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখতেই ইদ্দতের কথা বলে।
দ্বিতীয়ত, হামেশাই শোনা যায়, ইসলামে তালাক দেওয়ার একতরফা অধিকার শুধু পুরুষেরই। জ্ঞাতার্থে জানাই, নিকাহ (বিবাহ)-র সময় নিকাহ’র কাবিননামায় (চুক্তিপত্র) স্ত্রী ও তাঁর পিতা (কিংবা পিতৃকুলের কেউ) স্ত্রীর তরফে তালাক দেওয়ার অধিকার সংবলিত কথা লিখিয়ে নিতে পারে। একে বলে ‘তফবীযে তালাক’।
তৃতীয়ত, যদি জীবনের শুভারম্ভের মুহূর্তে তালাকের মতো গর্হিত ও অমঙ্গলসূচক বিষয় এড়াতে ‘তফবীযে তালাক’ দেওয়ার অধিকারের কথা কোনও স্ত্রী বা তাঁর পক্ষের কেউ নাও লিখিয়ে রাখেন, তবু তিনি কোনও অনিবার্য পরিস্থিতে স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকারী। এই ধরনের তালাককে বলা হয় ‘খোলা তালাক’ বা ‘খুল্লা তালাক’। স্বামী যদি উন্মাদ, ব্যাভিচারী, বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী হয় এবং কোনও ভাবেই স্ত্রী তাকে সঠিক পথে না আনতে পারে তবেই ‘খোলা তালাক’ প্রযোজ্য। পবিত্র কোরানের সূরা বাকরাহ-র ২২৬-২৪২নং আয়াত (লাইন)-এর মধ্যে তালাক নিয়ে যে দীর্ঘ আলোচনা, তার মধ্যে ২২৮ নং আয়াতে নারীদেরও অনুরূপ ন্যায়সঙ্গত অধিকারের ইঙ্গিত আছে।
চতুর্থত, ইসলাম যে তালাককে বিবাহবিচ্ছেদের তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য পথ হিসেবে খোলা রাখে তা হল ‘রজয়ী তালাক’। কারণ, এই তালাকে ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষা ও স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ভুল সংশোধনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। সুযোগ আছে স্বামীর তরফে স্ত্রীকে মর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে আনার। এই ফিরিয়ে আনাকে বলা হয় ‘রজআত’। কিন্তু ইদ্দত পেরিয়ে গেলে যেহেতু স্বামী স্ত্রীর প্রতি অধিকার হারায়, তাই সেক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনতে গেলে স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে পুনরায় নিকাহ করে আনতে হবে। কারণ, ইদ্দত পেরিয়ে গেলে ‘বায়েন তালাক’ হয়ে যায়।
‘বায়েন তালাক’ কি? কোনও দাম্পত্য যখন সম্পর্কের পুনর্জাগরণের সকল সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলে, যখন একসঙ্গে থাকাটাই বরং মনে হয় বেঁচে থাকার পক্ষে অভিশাপ, (ব্যভিচারের অকাট্য প্রমাণ, লাগামছাড়া স্বেচ্চাচার ইত্যাদি) কেবল মাত্র তখনই ইসলাম স্বামীকে অধিকার দিয়েছে জীবনের স্বার্থে শেষ অস্ত্র হিসেবে ‘বায়েন তালাক’ দিয়ে স্ত্রীর নাগপাশ থেকে মুক্তির। উল্লেখ্য, এই ‘বায়েন তালাক’ একই সময়ে তিন বার কিংবা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিন বার উচ্চারিত হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, ব্যভিচারী, স্বেচ্ছাচারী স্ত্রীর নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে স্বামীর হাতে যেমন ‘বায়েন তালাক’, তেমনই একই কারণে স্ত্রীর হাতে ‘খোলা তালাক’এর অধিকার আছে। অর্থাৎ, এই দু’প্রকার তালাক একে ওপরের পরিপূরক, যা স্বামী-স্ত্রী উভয়কে একে অপরের কাছে অযাচিত ভাবে বেঁধে রাখাকে রোধ করে। উভয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের স্বার্থে। শুধুমাত্র ডিভোর্স না দেওয়া ও ডিভোর্স না পাওয়ার জন্য মানুষের জীবন যাতে শেষ হয়ে যায় না যায়, তার জন্যই ইসলাম এই দু’প্রকার তালাকের সংস্থান রেখেছে। তা-ও শেষ অস্ত্র হিসেবে। সূরা বাকরাহ-র ২৩১নং আয়াতে কাউকে প্রেমহীন দাম্পত্যের ঘেরাটোপে অন্যায় ভাবে আটকে রাখার বিপক্ষে সওয়ালের ইঙ্গিত রয়েছে।
মুশকিল হল, সব দেওয়ালেরই দু’পিঠ আছে। এই দু’প্রকার তালাকই যেহেতু একতরফা সম্ভব, তাই তার সুযোগ নিয়ে কিছু দুরভিসন্ধিমূলক মানুষ (মূলত পুরুষেরা) অনেক সময় এর অপব্যবহার করে। ইসলামের চোখে তালাক কতটা গর্হিত ও নিকৃষ্ট তা না ভেবেই। এমনকী, কোন পরিস্থিতিতে, কী ধরনের অপরাধে কোন তালাক দেওয়া জায়েজ (ইসলাম সম্মত) এবং তার পদ্ধতিগত ধাপগুলি ঠিকঠাক মানা হল কি না সেটা না ভেবে। সর্বোপরি, দেখা দরকার পারস্পরিক সংশোধন ও সম্পর্কের পুনর্জাগরণের সুযোগ দেওয়া হল কি না। এ সব না ভেবে নিছক হঠকারিতা কিংবা বহুবিবাহের লিপ্সা থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বিবাহবিচ্ছেদের সহজলভ্য ছাড়পত্র বানানো মেনে নেওয়া যায় না। এর ফলে কত নারীর জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে, তার হিসাব করতে বসলে চোখ ভিজে যাবে।এই অপব্যবহারের হোতা যারা, তাদেরকে ইসলাম ধর্মে ক্ষমার অযোগ্য পাপী বলেই মনে করা হয়।
মুশকিল হল এই ভুল মানুষগুলির জন্য ইসলামে তালাক নিয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নিয়েছে।
শক্তিনগর হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy