মৃত্যুতে সবাই সমান। তা হলে কিছু মৃত্যু কেন পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে ওঠে? ‘সদ্গতি’-র দুখী চামারের মৃতদেহ যেমন ভারী হয়ে উঠেছিল গ্রামের ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাছে! নন্দীগ্রাম পর্বে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া ভরত মণ্ডলের ক্ষতবিক্ষত দেহও কি কম ভারী ছিল? বা সম্প্রতি গড়িয়া শ্মশানে দাহ করার জন্য নিয়ে আসা তেরোটি শব, শেষ পর্যন্ত যাঁদের গতি হল ধাপার মাঠে?
মানসিক হাসপাতালে কাজের সুবাদে মৃত্যু দেখতেই হয়। সম্প্রতি এক মৃত রোগীকে ওয়ার্ডের বারান্দায় ফেলে রেখেছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্য রোগীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সেখানে। কর্তৃপক্ষ অন্যায় দেখেননি, ‘আমরা তো ওয়ার্ড থেকে বার করে দিয়েছি, বারান্দায় ছিল, অসম্মান কোথায়!’
আসলে মানুষের মৃত্যুর পরেও তার শরীর নিয়ে রাজনীতি চলে। যে মানুষ ক্ষমতার রাজনীতির চোখে মূল্যহীন, মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ মর্যাদা পায় না। অথচ মৃতকে সম্মান জানানোর একটা প্রচলিত ধারণা তৈরি আমাদের ভিতর। শবদেহের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ দেখে সেটা ধাক্কা খায়। ওই আচরণ বুঝিয়ে দেয়, রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের স্থান কোথায়। গড়িয়া শ্মশানের মৃতদেহগুলি কোভিড আক্রান্তদের ছিল না বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার। তাতে কিছু যায় আসে না। সব অনিয়ম ত্রুটিবিচ্যুতির দায় কি শুধু ভাইরাসের? আগামী কয়েক মাসে মৃত্যুর হার বহু গুণ বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। তাই মৃত্যু এবং মৃতদেহের রাজনীতি নিয়ে কথা বলার এটাই সময়!
ভারতীয় সংবিধানে আছে, জীবনের অধিকার আসলে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার। নাগরিকের মৃত্যুর পর তাঁর দেহেরও এই সম্মান প্রাপ্য। মৃতদেহের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জীবিতাবস্থায় সেই ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক রীতি, পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা। একাধিক মামলায় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত মৃত ব্যক্তিকে তাঁর ধর্মবিশ্বাস অনুসারে উপযুক্ত শেষকৃত্যের রায়ই দিয়েছে, সেই দেহ অজ্ঞাতকুলশীল, দাবিদারহীন হলেও। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মৃত ব্যক্তির অধিকার ও তাঁর প্রতি আচরণ কেমন হবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। মানবাধিকার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জ স্পষ্ট বলেছে, সম্মানের সঙ্গে, ঠিক পদ্ধতি ও প্রয়াত ব্যক্তির পারিবারিক প্রথা মেনে শবদেহের সৎকার করতে হবে।
পরজন্মে বিশ্বাসও মৃত্যুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। তর্পণ বা শ্রাদ্ধের মধ্যে সেই শ্রদ্ধা বা বিশ্বাসই ধরা আছে। আধুনিক রাষ্ট্র শহিদ সেনার দেহকে গান স্যালুট দিয়ে সম্মান জানায়। সেই রাষ্ট্রই যখন নাগরিকের জীবিত বা মৃত দেহকে তাচ্ছিল্য করে, তখন তার দায়িত্বশীল, কল্যাণকামী ভাবমূর্তি চুরমার হয়। কয়েক মাস আগে রাজ্যে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর জীবাণুনাশক স্প্রে করল উত্তরপ্রদেশ সরকার। সে রাজ্যেরই এক পুরসভা পুলিশের উপস্থিতিতে, আবর্জনাবাহী গাড়িতে বহন করল এক বেওয়ারিশ দেহ, সম্ভবত করোনার ভয়ে।
যে কারণে এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রাজ্যগুলির জবাব তলব করেছে, সে বিষয়ে রেড ক্রস বহু আগেই সতর্ক করেছিল বিশ্বকে। কোভিড-জনিত বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ কী ভাবে সাবধানতা মেনে ও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে সৎকার করা যায়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট গাইডলাইন আছে রেড ক্রসের। উপযুক্ত পরিকল্পনা না থাকলে গণকবর দেওয়ার পরিস্থিতি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মৃতদেহগুলিকে শনাক্তকরণ যে সম্ভব হবে না, ফলে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে এক দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে, তা-ও জানিয়েছিল রেড ক্রস। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল, অতিমারি মোকাবিলায় তারা যথাবিহিত প্রস্তুতি নেবে।
অথচ আমরা দেখলাম জঞ্জালের স্তূপে পড়ে থাকছে কোভিড রোগীর দেহ, মৃতদেহ যথাযথ শনাক্ত হচ্ছে না, অন্য রোগে মৃত ব্যক্তির সৎকার হচ্ছে কোভিড রোগী পরিচয়ে। যথাযথ পরিকল্পনা, হাসপাতাল ও মর্গের কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো এড়ানো যেত এই পরিস্থিতি। মৃতরা প্রাপ্য সম্মান পেতেন, যন্ত্রণামুক্ত হতেন তাঁদের পরিবারের মানুষরা। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোভিডে মৃত্যু হলে মৃতের নিকটজনদের শেষ দেখার অনুমতি দিয়েছে। এত দিন এই সুযোগ ছিল না! পরিজনদের কাছে যা চূড়ান্ত যন্ত্রণার। এর ফলে তাঁদের কারও মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হলে রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে পারে না! রাষ্ট্রের কাছে কেন এটুকু প্রত্যাশাও করতে পারছেন না নাগরিকেরা, এর উত্তর বোধ হয় লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রের চরিত্রেই— যে জীবিতকে সম্মান দিতে জানে না, সে মৃতকে সম্মান দেবে কী করে?
মৃতকে সম্মান মানে কী? ফুল, ধূপকাঠি? বোধ হয় না! সম্মান আসলে সম্যক ভাবে শ্রদ্ধা করা। এক ভদ্রলোকের কথা বলে শেষ করি। রেললাইনের ধারে থাকতেন তিনি, রেলে কাটা পড়ে মারা যাওয়া শরীরগুলোকে সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া ছিল তাঁর কাজ। কেউ তাঁকে এ দায়িত্ব দেয়নি, তিনি নিজেই নিয়েছিলেন এ কাজের ভার। সে জন্য নিজের ঘরে, নিজের খরচে সাদা কাপড় জোগাড় করে রাখতেন তিনি। এঁর কাছে কি শিখতে পারে না রাষ্ট্র?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy