— আজ কী পাঠ হচ্ছে?
— হিতোপদেশ।
— হিতোপদেশ? কার উপদেশ? হিতাহিতের বিচার করে কে?
উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালায় গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রদের এই প্রশ্নই করেছিলেন। উত্তরও তিনিই দিয়েছিলেন, “করেন— হীরক রাজ।”
দেশের উচ্চশিক্ষার পাঠশালে সরকারি ফরমান এসেছে: ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা করতে হবে এমন বিষয় নিয়ে, যা ‘জাতীয় স্বার্থ’-এ লাগবে। ‘জাতীয় স্বার্থ’ কিসে, তার বিচার করে কে?— ভারত রাজ?
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের উদ্যোগে দেশের সব কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, ডিন এবং ইউজিসির কর্তাদের নিয়ে এক সভা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, পিএইচ ডি করছেন যাঁরা সেই সব ছাত্রছাত্রীকে গবেষণার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় অগ্রাধিকার’ মাথায় রাখতে হবে। “অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে যেন উৎসাহিত করা না হয়।” এই সিদ্ধান্তের ভূতই গত ১৩ মার্চ ‘নির্দেশিকা’ রূপে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পৌঁছে গিয়েছে এবং বলা হয়েছে ভবিষ্যতের গবেষকদের ভর্তি হওয়ার সময় যেন শর্তটি জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবাদ করেছেন অনেকেই। কেরলের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্যের ‘বোর্ড অব স্টাডিজ়’ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন অধ্যাপক মীনা টি পিল্লাই।
মীনা যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা ভারতের বহু শিক্ষাবিদের মনেই জেগেছে। কে ঠিক করবে, কোন বিষয় জাতীয় স্বার্থের পক্ষে? কে-ই বা ঠিক করবে, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বিষয় কোনগুলি? সত্যি বলতে কী, জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে এমন কোনও বিষয় কি আছে যার সম্পর্কে আগে থেকেই এমন বিধান দিয়ে দেওয়া চলে যে, তা দেশের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষকদের জানার জগৎকে কোনও না কোনও ভাবে সমৃদ্ধ করে না? শিক্ষাকে কি ‘রাষ্ট্রীয় রশি’ দিয়ে বেঁধে ফেলা যায়? কেন শিক্ষার উপর সিংহাসন এই ভাবে হস্তক্ষেপ করবে? ‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে’ বলে? এমন অভিযোগ বিরোধী দলের নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষা সংস্কৃতি জগতের অনেকেই করছেন।
গণেশের মাথার ক্ষেত্রে ‘প্লাস্টিক সার্জারি’ তত্ত্ব, পুষ্পক রথের ক্ষেত্রে ‘এরোপ্লেন’ তত্ত্ব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কি গবেষণার জগতে এমন নিয়ন্ত্রণ দরকার— এমন সন্দেহ জেগেছে যুক্তিবাদীদের মনে। অধ্যাপক মীনার ইস্তফার খবর আমাদের কানে এসেছে। আরও কত জন উদয়ন পণ্ডিতকে যে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা প্রবল ক্ষোভে তাঁরা সরে যাচ্ছেন, সব বৃত্তান্ত কি সকলে জানেন? সম্প্রতি প্রয়াত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের ইস্তফা নিয়েও তো বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। একটি জাতিকে কব্জা করতে গেলে তার ভাষা, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞানকে দখলে আনতে হয়। তার মস্তিষ্কটিকেই বিকৃত বা অকেজো করে দিতে হয়। তাই উচ্চশিক্ষার উপর এমন আক্রমণ বলে মনে করেন সমালোচকরা। প্রশ্ন ওঠে, ‘দেশের অগ্রাধিকার’-এর যে তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে, তাতে দলিত বা সংখ্যালঘু সমস্যা থাকবে? অবিজ্ঞান-বিরোধী বিষয়গুলি থাকবে? ইতিহাস-বিকৃতির সমস্যা থাকবে? প্রতিবাদী সাহিত্য থাকবে?
কৃষক ফজল মিয়াকে ‘যন্তরমন্তর’-এ পাঠানোর আগে শেখানো হয়েছিল, ‘‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভাল কাজ না।’’ খাজনা বাকি রাখার অধিকার তো কেবল বিজয় মাল্য, নীরব মোদীদের। বাকিরা অনাহারে থেকেও রাজার খাজনা মেটাবেন। বেশি খেলে যদি বুদ্ধির মেদ বাড়ে? যেমনই থাকুন দেশের জনগণ, মুখে যেন উচ্চারিত হয়, “যায় যদি যাক প্রাণ /হীরকের রাজা ভগবান!” এ দেশের প্রজাদের ঘরে মহিলাদের অবস্থা ভয়াবহ, তাঁদের আর্থিক ভাবে কর্মক্ষম করা যায়নি। এ দেশে বেকারি বাড়ছে রেকর্ড হারে। দেশের মানুষ ‘অসুখী’। দেশের জওয়ানদের জীবনের অপচয় হচ্ছে— যুদ্ধক্ষেত্রে নয়— পথ চলতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী বিস্ফোরণে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কোথাও আশার আলোর দেখা নেই। তাই কি ‘নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া’দের মুখ সবার আগে বন্ধ করা দরকার? ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র তোতা-জাতীয় মিথ্যা ব্যালট বাক্সে ছাপ ফেলবে না, এই ভয়েই কি দেশের মস্তিষ্কের উপর এমন মরিয়া আক্রমণ?
হীরক রাজার দেশে কিন্তু শেষ কালে উদয়ন পণ্ডিতই জেতেন। কারণ জ্ঞানই স্বাধীনতা, আর স্বাধীনতাকে রোখা যায় না। পাঠশালা বন্ধ করেও না। শেষ কালে পণ্ডিত ছাত্রদের বলবেনই, “চল মূর্তির মাঠে!” আসলে আমরাও হয়তো সকলে মূর্তির মাঠটা খুঁজছি। সেখানে মহামানবকে আকাশ ছোঁয়াতে গিয়ে কে জানে কত সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব মাটিতে মিশে গিয়েছে! আর উদয়ন পণ্ডিতের স্লোগানকে ভয় পায় না, এমন রাজা কি বিশ্বে কোথাও আছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy