বিলেতে আজ সাধারণ নির্বাচন। বরিস জনসন বা জেরেমি করবিন কাল নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এসেই নিশ্চয় ব্রেক্সিট নিয়ে ব্যস্ত হবেন। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে চুক্তি স্থির না হলে হয়তো ই-ইউ আর সময় দেবে না। তার মধ্যে ব্রেক্সিট-এর পরিণতি যে ঠিক কী হবে, সন্দীপন চাটুজ্জের উপন্যাসের নাম ধার করে বললে, আমি বা কেউ-ই সে ‘সম্বন্ধে দু-চার কথা জানি না’। মুশকিল হল, ই-ইউ’এর সঙ্গে সমঝোতা হলেও বিলেতের এমপিরা সহজে যে কোনও ‘ডিল’ মেনে নেবেন না। বরিস বা করবিনরা নিজেরাও এখন জানেন না, আগামী দেড় মাসে বিলেতের পার্লামেন্ট কোন পথে হাঁটতে চলেছে— পরিকল্পনামাফিক জানুয়ারির শেষ দিনে ব্রেক্সিট কেমন হবে অথবা আদৌ হবে কি না। সত্যিই, গত সাড়ে তিন বছরে ব্রেক্সিটের দাপটে একাধিক প্রধানমন্ত্রীর ‘এক্সিট’ বিলেত দেখেছে; বরিস নিজেই তো অক্টোবরের শেষে তীরে এসে তরী ডুবতে দেখে নির্বাচন ডাকতে বাধ্য হয়েছেন।
আগের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বলেছিলেন: হয় ‘মাই ডিল’ মেনে নাও, না হলে হাতে থাকবে ‘নো ডিল’, অথবা ‘নো ব্রেক্সিট’। এই তিনের বাইরে আর কোনও পথ নেই। সুতরাং ব্রেক্সিট মানে দর-কষাকষি, তবে তা শুধু ই-ইউ আর ব্রিটেনের মধ্যে নয়, সব দলের এমপিদের মধ্যেও। সাদা বাংলায়, যার যত ‘বার্গেনিং পাওয়ার’, তার তত সুবিধে।
তত্ত্বের পরিভাষায় ‘বার্গেনিং’ বা দর-কষাকষি ব্যাপারটা একটা ‘গেম’। আধুনিক অর্থনীতির শাখা গেম থিয়োরি-র তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে এর আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। তবে এখানে কিন্তু গেম থিয়োরিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ব্রেক্সিট সমস্যাটা ঠিক কী, তা বোঝানো সম্ভব একটা সহজ উদাহরণের মাধ্যমে: বিবাহবিচ্ছেদ। ডিভোর্স নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের ছুতমার্গ বেশ কিছু কাল হল ঘুচেছে। বিবাহবিচ্ছেদের গল্প বা ‘গসিপ’ এখন আর আমাদের রসালো বলে মনেই হয় না। এ এখন ঘর ঘর কি কহানি।
ডিভোর্স নিয়ে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়ে গেলেও তবু এখনও কোনও বিচ্ছেদকামী দম্পতিকে তাঁদের ডিভোর্স-পরবর্তী জীবন কেমনতর হবে, তার আভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। বিবাহবিচ্ছেদের পরে ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট নারী ও পুরুষের জীবনের অভিমুখ নানা দিকেই বইতে পারে। অনেকে ‘প্রাক্তন’-এর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেন না। আবার অনেকে বিচ্ছেদের পরে বন্ধু হিসেবে থাকেন। নতুন-পুরনো পরিবারের সকলে মিলে, সব পক্ষের সন্তানদের নিয়ে স্কুলের ছুটিতে বেড়াতে যান।
কলকাতারই বাসিন্দা এক আধুনিক দম্পতির কথা বলি, উদাহরণ হিসেবে; বলাই বাহুল্য, সব চরিত্রই এখানে কাল্পনিক। অঙ্কের ভাষায়, ধরা যাক, আমাদের এই গল্পের দুই পাত্রপাত্রী হলেন A আর B: A(মিত) আর B(ন্যা)। অমিত আর লাবণ্য প্রায় তিন দশক ধরে নিজেদের চেনেন, সিকি-শতাব্দীর পরিণয়-বন্ধনে তাঁরা আবদ্ধ, একটি বছর-কুড়ির মেয়ে, আর বারো বছরের এক ছেলে আছে তাঁদের।
এ-হেন কবিতাও শেষ হয় বইকি; অমিত-লাবণ্যের দাম্পত্যজীবনে এখন খিটিমিটি লেগেই থাকে। দু’জনে মিলে এত দিন ধরে জীবনের নানা ওঠাপড়া সামাল দিয়েছেন, নিজেদের, বিশেষত সন্তানদের গায়ে লাগতে দেননি। কিন্তু, শেষের এই কবিতায় ওদের মনেও বিবাহবিচ্ছেদের প্রশ্ন ওঠে। নানা ক্ষেত্রেই এখন আর তাঁদের কাজের ও মতের মিল হয় না। তবু, ডিভোর্স করা ঠিক হবে কি না আর করলেও বিচ্ছেদের পরে তাঁদের সম্পর্ক কেমন হবে সেই প্রশ্নটার সমাধানে তাঁরা পৌঁছতে পারছেন না। অমিত আর লাবণ্য তাই স্থির করলেন তাঁদের পরিচিত ঠিক একশো জন আত্মীয়-পরিজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবের মত নেবেন। তা-ই হল। বাহান্ন জন ডিভোর্সের পক্ষে ও আটচল্লিশ জন বিপক্ষে ভোট দিলেন। তবে, উত্তরদাতারা জবাবে শুধু হ্যাঁ-না বললেন; কেন ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’, তার কোনও কারণ বা ব্যাখ্যা দিলেন না। কেউ হয়তো ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবেই অমিত আর লাবণ্য-র ডিভোর্স চাননি; কেউ বা আবার স্বাধীনচেতা লাবণ্য-র মানসিক শান্তির জন্য বিচ্ছেদের শলা দিয়েছেন।
বড় সমস্যা হল, বিবাহবিচ্ছেদের দল ৫২-৪৮ ভোটে জিতলেও অমিত, লাবণ্য ও তাঁদের বাচ্চাদের জীবন এর পরে কেমন হবে সে বিষয়ে কোনওই দিশা মেলেনি। অগত্যা, অমিত ও লাবণ্য তাঁদের দুই পরিবারের বয়স্কদের ভার দিয়েছেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার। প্রশ্ন অনেক। যেমন, বিচ্ছেদের পর অমিত আর লাবণ্য একে অন্যের পারিবারিক বাড়িতে অবাধে ঢুকবেন কি না, ছেলেমেয়েরা কে কোথায় থাকবে, মেয়ের নাচ, ছেলের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কী ভাবে চালু থাকবে, ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়। সব বিষয়েই কি এখন চুক্তি সই করা হবে, না কি ‘নো ডিল’ হবে, যে দিন যে রকম— অবস্থা দেখে ব্যবস্থা?
এই সব নিয়ে দুই পরিবারের ঝকাঝকি শুরু হয়েছে; দুই তরফের দায়িত্বে রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের নিজেদের ব্যক্তিগত মত নিলেই তো হবে না! দু’পক্ষের সমঝোতা না হলে তো ডিভোর্সই হবে না!
তা হলেই বুঝুন, বিলেতের নতুন এমপিরা ভোটে জিতে কী ফাঁপরে পড়তে চলেছেন !
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy