গত ডিসেম্বরে যখন বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, সে-সময় এই পত্রিকায় প্রকাশিত আমার এক নিবন্ধে লিখেছিলাম, “মোদী-শাহ যুগল কী ভাবে প্রত্যাঘাত করবেন সেটাও আমাদের অজানা। একটা আশঙ্কা অনেকের মনেই আছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা।” (‘বহুত্ব, শেষ পর্যন্ত’, ২৭-১২)। আজ যখন সেই ‘দাঙ্গা’ সফল ভাবে কার্যকর করা হচ্ছে, প্রাণহানিও হচ্ছে, তখন খুব গভীর ভাবে বোঝা প্রয়োজন যে, আমাদের লড়াইটা আসলে কার বিরুদ্ধে। একটি সংশোধনীকে আইনে পরিণত করা নিয়ে যে স্বতন্ত্র প্রতিবাদের সূচনা, গত কয়েক সপ্তাহের বিনিদ্র রাত্রিগুলো পেরিয়ে সেটাই আরও অনেক বিস্তৃত হয়ে দেশব্যাপী এক বহু-ধর্মীয় লড়াইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এই লড়াই কর্তৃত্ববাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী। যে মুসলমান নাগরিক এ-যাবৎ লাঞ্ছিত হয়েও সাবধানি থেকেছেন, সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর মতো তিনটি ঘৃণা-উদ্রেককারী শব্দ তাঁকেও শেষ পর্যন্ত রাস্তায় টেনে নামিয়েছে। গত পাঁচ বছরের সীমাহীন নিপীড়নে তিনি বীতশ্রদ্ধ। রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পেলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের এক ঐকান্তিক সমর্থন, যে নিরপেক্ষ ভারতকে এক সময় আগ্রাসী সংখ্যাগুরুবাদ ঠেলে দিয়েছিল নিকষ অন্ধকারে।
যে ব্যাপারটি আমাদের আরও মুগ্ধ করে, তা হল— সাধারণ মুসলিম মহিলা, সন্তানকোলে গৃহবধূ, আর ক্রুদ্ধ অল্পবয়সি শিক্ষিত মুসলিম মেয়েরা, যাঁরা আগে কখনও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াননি, তাঁরাই এই লড়াইয়ে অভূতপূর্ব নেতৃত্ব দিয়েছেন। একই কৃতিত্ব প্রাপ্য প্রথম বার প্রতিবাদে পথে নামা কয়েক লাখ মানুষেরও। তাঁরা ‘ভয়ের ভয়’কে জয় করেছেন। আর এটাই বর্তমান শাসক দলের সবচেয়ে বেশি চিন্তার কারণ। ভারতের ইতিহাস সেই শিখ ও হিন্দুদের কথা সহজে ভুলবে না, যাঁরা ঐক্যের প্রতীক হয়ে প্রতিবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, খাবার বিতরণ করেছেন, কড়া ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে বিক্ষোভকারীদের হাতে কম্বল তুলে দিয়েছেন। শাহিন বাগ থেকে পার্ক সার্কাস এবং ভারতের আরও ডজনখানেক জায়গার বাতাস সমৃদ্ধ হয়ে আছে এই পারস্পরিক আস্থার অগণিত কাহিনিতে। অসংখ্য হিন্দু শিখ খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধেরা সিএএ-র দেওয়া বিশেষ মর্যাদা ছুড়ে ফেলে অবিচারের শিকার মুসলিমদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও গত দশ-বারো সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর গভীরতর অর্থ অনুধাবন করা দরকার। এবং বোঝা দরকার যে, দিল্লির ‘দাঙ্গা’ হল এমন এক জমানার প্রথম গুরুতর প্রতিক্রিয়া, যারা গণতান্ত্রিক আলোচনার পথটিকে ধারাবাহিক ভাবে অবজ্ঞা করে এসেছে। এবং এই প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দেয়, তাদের ধৈর্যের ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসছে। যে ভাবে হিংস্র মুখোশধারীদের জেএনইউ-তে পাঠানো হয়েছিল বিরোধীদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে, তা ছিল এই জমানার নয়া পিপিপি বা ‘প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ’ মডেল-এর এক ছোট ট্রেলারমাত্র। এই নতুন মডেলে অভিজ্ঞ অপরাধীদের হাতে হিংসা ছড়ানোর ভার তুলে দেওয়া হয়। জেএনইউ-এর ঘটনা নির্লজ্জ ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, পুলিশের হাত থেকে তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা রাষ্ট্রই জোগাবে। এবং এই শাসকেরা চান, বিচারকেরাও তাঁদের আজ্ঞাবহ হবেন, নয়তো রাতারাতি তাঁদের বদলি করে দেওয়া হবে। পুলিশের বন্দুকবাজ অংশটিকে খুশি রাখতে পিপিপি রাষ্ট্র এর পর হয়তো তাদের পাঠাবে জামিয়া বা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাছাই করা জায়গায় এবং গুয়াহাটি, ম্যাঙ্গালুরু, লখনউ বা চেন্নাইয়ের বিভিন্ন সমস্যাদীর্ণ অঞ্চলগুলোয়।
মোদী ইন্দিরা ২.০ নন। স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী নিঃসন্দেহে সমস্ত বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটাও ঠিক যে, তিনিও সর্বত্র ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতেন। কিন্তু যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁকে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল, তাঁর জমানায় সেই ব্যবস্থাটির কাঠামোয় বিষ ভরে দেওয়া হয়নি। মোদী জমানা এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে পর্যবসিত হওয়ার পরেও হয়তো কয়েক দশক ধরে এই কেমোথেরাপির বিষযন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতাকে এতটা সম্মান এই প্রথম দেওয়া হল। আগামী দিনের ভারত যদি জাতিবিদ্বেষের সরীসৃপদের গর্তগুলো বন্ধও করে দিতে পারে, তা হলেও তারা মাটির নীচে ফুঁসবে।
দ্বিতীয় পার্থক্য হল, নেহরু বা বাজপেয়ীর মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি যে দায়বদ্ধতা ছিল, এই জমানার শাসকদের মধ্যে তা নেই। এবং কেউ বলতে পারে না বিপর্যয়ের মুখে এঁরা কী পদক্ষেপ করবেন। স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরাকেও ১৯৭৭ সালের নির্বাচনী ভরাডুবি সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু এর আগে ভারতীয় নাগরিকদের কখনও সশস্ত্র বাহিনী এবং ‘রাষ্ট্র’কে পুজো করতে শেখানো হয়নি। এই জমানায় সেটা হয়ে চলেছে, এবং তা ঘটছে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শাসক দলের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতাকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবল তাগিদে।
সাম্প্রতিক হিংস্র আক্রমণগুলো আসলে নাগরিকত্ব আইনের অন্যায় সংশোধনের বিরুদ্ধে দেশজোড়া বিক্ষোভের মুখে শাসক দলের এক চটজলদি প্রতিক্রিয়া। সাম্প্রতিক নির্বাচনে দিল্লির ভোটারেরা যে ভাবে বিজেপিকে ছুড়ে ফেলেছেন, তার প্রেক্ষিতে এই প্রতিক্রিয়া শাসকের অসন্তোষ জ্ঞাপনের এক চিত্রও বটে। এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই, মুসলিম জঙ্গিপনার মুখে দাঁড়িয়ে হিন্দুরা কতটা অসহায়, দুই পুলিশকর্মীর মৃত্যুর ঘটনাকে তার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হল। অবশ্যই এই জাতীয় ব্যাখ্যা আসল তথ্যটি এড়িয়ে যায় যে— নিহত হয়েছেন প্রধানত মুসলিমরাই। দাঙ্গার মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা আছে যাঁদের, তাঁরা জানেন প্রথম ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখামাত্রেই তথ্য সংগ্রহ করা কতটা জরুরি এবং আগাম-গ্রেফতারির মতো অতি-দ্রুত পদক্ষেপ কী ভাবে দাঙ্গার এই বিধ্বংসী চেহারাকে ঠেকাতে পারে। এই পদক্ষেপগুলি করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ২৩ ফেব্রুয়ারি বিজেপির প্রতাপশালী নেতা কপিল মিশ্রকে জাফরাবাদ এবং চাঁদ বাগের বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী প্রচারের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। এর পরেই আক্রমণ শুরু হয়। লক্ষণীয়, ‘দাঙ্গা’র সমস্ত ঘটনাই উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটি ছোট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, স্থানীয় ভাষায় যার নাম যমুনা-পার। দিল্লির ভোটদাতা এবং বিধানসভা আসনের দশ শতাংশেরও কম রয়েছে যমুনা নদীর পূর্ব তীরের এই সরু টুকরোটিতে। এবং এইখানেই সম্প্রতি বিজেপি তার আটটি জয়ী আসনের ছ’টি পেয়েছে। খাজুরি খাস, মৌজপুর, করওয়াল নগর, সীলমপুর, ভজনপুরা-র মতো বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলি বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। এখানেই বাছাই-করা নিশানার উপর আক্রমণের সময় পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। দিল্লির বাকি অংশে এমনটা হয়নি (বা করা যেত না), এমনকি শাহিন বাগ, জামিয়া নগরের মতো সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ জায়গাতেও নয়।
কপিল মিশ্রের প্ররোচনামূলক বক্তৃতা এবং টুইট ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্তত আধ ডজন শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংক্রান্ত ধারা লঙ্ঘন করেছে। এর শুরু কয়েক মাস আগেই, যখন তাঁর নেতৃত্বে স্লোগান তোলা হয়েছিল ‘গদ্দারোঁ কো গোলি মারো’। তিনি কট্টর বিজেপি এবং আরএসএস ভাবধারায় বিশ্বাসী, এবং অনায়াসে রেহাই পেয়ে যান। রাজ্য থেকে জাতীয় স্তরে তাঁর দ্রুত উত্থানের জন্য তিনি হয়তো এই ‘দাঙ্গা আর রক্তপাত’-এর ভয়ঙ্কর সফল ফর্মুলাই প্রয়োগ করছেন। দিল্লি হাইকোর্টের বিবেকবান বিচারকেরা যদি উস্কানিমূলক ভিডিয়োগুলি খুঁটিয়ে না দেখতেন, এবং সুপ্রিম কোর্টের দুই দৃঢ়চেতা বিচারক দিল্লি পুলিশকে তীব্র ভর্ৎসনা না করতেন, দাঙ্গা হয়তো এখনও বিনা বাধায় চলত।
সংক্ষেপে বলতে হলে, এই দীর্ঘ সঙ্কট সহজে মেটার নয়। পরিকল্পিত গ্রেফতারি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার আগেই আমাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের অর্থে পরিচালিত অ-রাজনৈতিক বিক্ষোভের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এগুলো নিছকই প্রতিবাদ নয়, বরং, রুসো’র ভাষায় বললে, এ হল ‘সাধারণের ইচ্ছা’। এখন এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মুখের উপর বহুত্ববাদী ভারতের বহুপ্রতীক্ষিত উত্তর। বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দিতে এবং সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোকে ভাঙতে পুলিশ যে লম্বা লাঠিগুলো ব্যবহার করেছিল, সেগুলো আর তেমন আতঙ্ক জাগায় না। এমনকি অ-পুলিশি যে অস্ত্রগুলো হামেশাই বিক্ষোভকারীদের দিকে তাক করে ছোড়া হয়, তা-ও আর নিজেদের সবটুকু উজাড় করে-দেওয়া মানুষগুলোকে তেমন ভয় দেখায় না। আমরা এখন এক ঐতিহাসিক পর্বের সাক্ষী, যেখানে ‘সমাজ’ ব্যক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই পর্বে কমিউনিটিই হয়ে ওঠে যাবতীয় সামাজিক কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল, যেখানে হাসি-কান্না-আনন্দ-দুঃখ সব কিছুই পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়। কিছু পুজো মণ্ডপে এই ছবি দেখা যায়, কিন্তু বিক্ষোভ-শিবিরের ছবিটার তাৎপর্য আরও অনেক বেশি গভীর। প্রতিবাদের এক সংস্কৃতি এবং তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকাটা এক স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিশীলতার জন্ম দেয়। স্পর্ধিত কবিতা, প্রতিবাদী গান এবং বিদ্রুপঋদ্ধ স্লোগান শোনা যায় সর্বত্র। তীব্র গ্রাফিতি আর গণশিল্প সজোরে ধাক্কা দেয় ক্ষমতাবানকে। এ-সবেরই অর্থ হয়তো— ব্যক্তি নিজেকে ‘বৃহত্তর স্বার্থ’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। সে এখন শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত। পরিণাম যা-ই হোক না কেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy