দেশ জুড়ে চলছে মুম্বইয়ের শান্তনু নাইডুর স্বপ্নপূরণের চর্চা। একসময় রাস্তার কুকুরের মৃত্যু রুখে দেওয়ার কৌশল আবিষ্কার করে শেষতক রতন টাটার কাছে চাকরির সুযোগ পেয়ে সকলের মন জুড়িয়ে দিলেন শান্তনু। ঠিক তখনই আর এক মহানগরের রোহন রায় স্বপ্ন ও বাস্তবের টানাপড়েনে হার স্বীকার করে নিল। অভাব নয়, অশান্তি নয়, শুধু জীবনকে দেখার ফারাক। অভিভাবক ভাবেন, পড়াশোনাই শেষ কথা। সন্তানের বিশ্বাস, নিজের স্বপ্নের মুক্তিই জীবনের মূল কথা। দুই প্রজন্মের এই দর্শনের ফারাকে সন্তান খুঁজে নিল মায়ের শাড়ি। নিজেকে শ্বাসরোধ করে খুন করল সে। পরিবার হারাল কনিষ্ঠ সদস্য। ষষ্ঠ শ্রেণিতেই জীবনের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলল রোহন। নীচে অপেক্ষায় থেকে গেলেন টিউটর। দোতলার ঘর থেকে রোহন আর নেমে আসতে পারল না। তুলে দিয়ে গেল সেই চিরাচরিত প্রশ্ন— জীবন
আসলে কার?
আত্মহনন এখনকার কিশোরদের জীবনে জটিল অসুখ। দেখিয়ে দেওয়া বা দেখে নেওয়ার ধরনটা বেশ আলাদা। আত্মাভিমানে ভরপুর এই প্রজন্ম। প্রতিতুলনা একদম বরদাস্ত নয় তাদের। রোহনেরা নিজের কাছে নিজেই আইকন। যা পারে, যেটুকু পারে তাতে খেদ নেই। কিন্তু তাদের চলার পথে চায় না কোনও অতিরিক্ত পরামর্শ। দখলদারি ও নজরদারি একেবারে না–পসন্দ ওদের। নিজের সিদ্ধান্তে তারা পরিণত না হলেও দৃঢ়। সেখানে কোনও পক্ষপাত তাদের অত্যাচার মনে হয়। রোহনদের চেনার চোখ বদলাতে হবে এই
প্রজন্মের অভিভাবকদের।
ছোটরাও কিন্তু পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ‘ও তো ছোট, ও কী বোঝে!’— এ কথা বলার দিন শেষ হয়ে আসছে। আত্মীয়-পরিজনের সামনে অনেকেই বলেন, ‘আমার ছেলেটা না একদম পড়ে না।’ মনে রাখতে হবে, এমন কথায় তারা অসম্মানিত হয়। ছোটরাও চায় তাদের ‘প্রাইভেসি’কে সম্মান করা হোক। অভিভাবকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, এমন জোর ও জেদ বহাল রাখার বিরুদ্ধে ছোটরা প্রায়ই বিদ্রোহ করছে। প্রতিনিয়ত সন্তানের প্রশ্নের সামনে বিবশ অভিভাবক ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছুটছেন মনোবিদের কাছে। সেখানে জীবনের সমস্যা মেনে আপাত ভাবে তারা আশ্বস্ত হচ্ছে। কিন্তু নম্রতা ও বিনয়ের সংজ্ঞাটা ঠিক কী, তা কি এই প্রজন্মকে আমরা বোঝাতে পারছি? তাদের কোন স্বপ্নটা কেন দেখতে নেই তা কি যুক্তি দিয়ে আমরা
বলতে পারছি?
মনমরা ছেলেটিকে চাঙ্গা করতে কখনও যাঁরা অভিভাবকত্বের ছড়ি তুলে নেননি, সেই তাঁরাই অঘটনের পরে নিথর হয়ে যাওয়া আত্মজের জন্য কেঁদে ককিয়ে বলেন, ‘বুঝতে পারিনি।’ সন্তান শাসনের সেই ছড়ির উল্টো পিঠে লেখা ছিল ভালবাসা ও আদরের ভাষা। সেই ভাষা কেন ছেলেকে বোঝানো গেল না সে দায় পরিবারের মাথাতেই বর্তায়। মায়ের রান্নাঘর ও বাবার ক্যাব-জীবনের মাঝে রোহনের নকশিকাঁথার মাঠের বুনোট। আগামীর ফুটবলারের স্বপ্নে বিভোর রোহন হঠাৎ কেন হার মেনে নিল তার উত্তর খোঁজার দায় বিদ্যালয়েরও। পড়াশোনায় কি আনন্দ পাচ্ছিল না রোহন? তবে কি পরীক্ষা ও সিলেবাসের বোঝা তার কাছে ক্লান্তিকর ছিল? স্বপ্নের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চালাতে পারছিল না? নাকি কথায় কথায় ফুটবল খেলার খোঁটা সে সইতে পারছিল না?
রোহনরা চায় বাবা–মায়ের সমর্থন। বাচ্চাদের বিশ্বাস, সব স্বপ্নপূরণের চাবি বাবা-মায়ের কাছে রাখা আছে। ছোট থেকেই খেলনা থেকে বায়নার খাবারসব পেতে পেতে হঠাৎ না শুনলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ধীরে ধীরে তাদের নানা আবদারের সামনে, ‘তোর জন্য বাবা এত কষ্ট করছেন!’— এই জাতীয় কথায় তারা বিরক্ত হয়। বাবা-মা চান সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু তা নির্মাণের একমাত্র সন্ধান পড়াশোনাতেই আছে, এমন অঙ্গীকারপত্র পূরণ করার শর্তে পৃথিবীতে সন্তান আসে না! সন্তানের সাফল্য মানে পরীক্ষায় প্রথম বা প্রথম শ্রেণির চাকরি নয়। সেই সাফল্যে বাবা-মায়ের গর্বিত হয়ে সর্বসমক্ষে ঘোষণার লোভেই সন্তানকে নিরন্তর মানসিক অশান্তি দেওয়ার মানে হয় না। ‘যা বলছি তা তোর ভালর জন্যই’— এই নিরীহ বাক্যবাণে সন্তানের উপর চাপ বাড়ানোর ফল খারাপই হয়। অভিভাবক যেন হাসতে হাসতে বলতে পারেন, ‘আমার ছেলে পড়ে না, কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনে দারুণ ঝোঁক।’ পড়াশোনার বাইরেও উপার্জনমূলক কাজ আছে। সেই কাজও আনন্দের ও সম্মানের। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সেটা বোঝে ও মানে। কিন্তু অভিভাবকেরা সেই ভাবনাকে সম্মান দিচ্ছেন কি? অভিভাবক পথ নির্দেশক, বন্ধু ও সহযাত্রী। কিন্তু নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় এসে গেলেই মুশকিল।
সন্তানের সাফল্যের সঙ্গে অভিভাবকও আসলে ‘শাবাশ’ শুনতে চান। তিনিও শুনতে চান, ‘আপনি সন্তানকে দারুণ মানুষ করেছেন কিন্তু!’ সন্তানের ব্যর্থতা কি অভিভাবকের দিকে আঙুল তোলে? সম্মান নষ্টের দোষারোপ দিয়ে নিরীহ প্রাণকে ভারাক্রান্ত করে কি নিজেদের স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা? ছেলে ব্যর্থ মানেই অভিভাবক ব্যর্থ— এমন ভাবনা আমরা ভেবে নিচ্ছি কেন? অতি সম্প্রতি ‘ছিছোড়ে’ সিনেমায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ছেলেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরাতে বাবা নিজের জীবনের গল্প শোনাতে থাকেন। মনমরা ছেলের মধ্যেও জাগিয়ে তোলেন বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। এই অনুপ্রেরণার হাত সব সময় সন্তানের মাথায় রাখা জরুরি। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতা ও পারিবারিক সম্মানেরও নতুন পরিভাষা খোঁজা দরকার।
আত্মহনন একটি দীর্ঘ মানসিক প্রতিক্রিয়ার ফল। এই প্রতিক্রিয়াকে জীবন থেকে উপড়ে ফেলার জন্য দরকার উপযুক্ত স্বপ্ন ও ভালবাসার সঙ্গ। বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে ফর্ম পূরণ করা হয় তাতে কিছু প্রশ্নমালার অন্তর্ভুক্তি দরকার। তা থেকেই অনেকটা স্পষ্ট হবে বাচ্চার ভাবনার জগৎ। সেই অনুযায়ী বাচ্চাদের চিহ্নিত করে আলাদা ভাবে যত্নের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অভিভাবক যদি ভাবেন সন্তানের জীবনের জন্যই তাঁর এই প্রাণপাত, তাই আর বাড়তি সময় তাঁর কাছে নেই তবে সেটা ভুল ভাবনা। মা-ও যদি ভাবেন ছেলেদের রান্না করে খাইয়ে-পরিয়েও কেন ভাল ভাবে মানুষ হবে না— এই ভাবনাও অন্যায়। ওদের মনের খোঁজ রাখতে হবে। পরিবারে প্রবেশের জন্য আগাম শিশুমন ও প্রতিপালন নিয়ে পড়াশোনা দরকার। বিবাহ ও সন্তান পালন সামাজিক প্রক্রিয়া। শিশুরা যন্ত্র নয়। তাই এই যন্ত্র চালানোর ক্ষমতা চিরকাল অভিভাবকের হাতে থেকে যাবে, এমন ভাবনাও বৃথা। রোহন রায় তাই হয়তো সতর্কবার্তা দিয়ে গেল— ‘আমরা, ছোটরাও মানুষ। অযত্ন ও অবহেলায় আমরাও বাঁচতে ভুলে যাই!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy