দেখুন, আমি মুখের উপরে বলে দিয়ে এসেছি— অ্যারিস্টোক্র্যাট স্টুপিডদের সঙ্গে পার্টি করব না! হয়তো আপনাকে ওরা বলবে। আমিই জানিয়ে রাখলাম আপনাকে।” “বলে দিলে এই ভাবে! গিলে করা পাঞ্জাবি নিয়ে!” ওই রকম কথা শুনে অবাক হয়েও বেশ একচোট হাসলেন জেলা সম্পাদক। তার পরে নিজেই উদ্যোগী হয়ে এক জনের খোঁজ করলেন। পার্ক সার্কাস এলাকার তখনকার কমিটি সেক্রেটারি এসে হাজির হলেন। জেলা সম্পাদক জানতে চাইলেন, আপনি তো ইয়ং ছেলে খুঁজছিলেন। একে নেবেন? পার্ক সার্কাসের সাদিক সাহেব তো খুব খুশি। এক কথায় রাজি। তাঁর স্কুটার ছিল তখন। জেলা সম্পাদককে বিদায় জানিয়ে তাঁর স্কুটারের পিছনে আমাকে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হিন্দুস্তান কোর্টের পার্টি অফিস থেকে। স্কুটারে চেপেই আমি এগিয়ে গেলাম পার্টির কাজের নতুন এলাকার দিকে।
ঘটনাটা ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। হয়তো ১৯৬২ সাল হবে। জলিদার কথা এলেই সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে। সে দিনের কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদক ছিলেন জলি মোহন কল। জন্মসূত্রে কাশ্মীরের মানুষ। বাংলা বলতেন, ইংরেজি তো বটেই। তাঁর আমলেই পার্টির মেম্বারশিপ ট্রান্সফার করতে গিয়ে ওই রকম ঘটনা!
আরও একটু খুলে বলা যাক। ছাত্র রাজনীতি থেকে আমি তখন পার্টি করছি। কলকাতা জেলা কেন্দ্রে আমার সদস্যপদ। আমাদের বাড়ি ছিল গড়িয়াহাটে। কিন্তু নানা কারণে আমাদের বড় পরিবার ভেঙে তিন টুকরো হয়েছিল। একটা টুকরোর সঙ্গে আমি কয়েক বছর ঘুরে ঘুরে আমহার্স্ট স্ট্রিট, সারপেন্টাইন লেন, নারকেলডাঙায় থেকেছি। যত দূর মনে পড়ে, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট এলাকার এক জন আমার দলীয় সদস্যপদের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। যা-ই হোক, তার পরে রাসবিহারী এলাকায় আমাকে কাজ করতে দেওয়া হবে বলে জলিদা কাগজ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন বালিগঞ্জ লোকাল পার্টি অফিসে। মেম্বারশিপটা ওখানে ট্রান্সফার হবে। সেই অফিসে কাচের দরজা ছিল। ঠেলে ঢুকেছি, ভিতরে তিন জন ছিলেন। এক জনের পরনে প্যান্ট-শার্ট, বাকি দু’জনেরই গিলে করা পাঞ্জাবি! তখন ওটা স্টাইল ছিল। গিলে করা পাঞ্জাবি দেখলেই আমি খুব বিরক্ত হতাম। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে গিলে করা পাঞ্জাবি দেখে মাথাটা গরম হয়েছিল। বাবুয়ানি সহ্য হত না। ট্রান্সফার করাতে গিয়ে বলেই দিলাম, অ্যারিস্টোক্র্যাট স্টুপিডদের সঙ্গে পার্টি করব না! ওঁরা বললেন, “কী বললে, কী বললে?” আমি বললাম, “খারাপ কথা আবার বলব?” ওঁরা বললেন, “শুনতে পাইনি।” কথাটা আবার বলে কাগজ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। করাব না ট্রান্সফার। ওখান থেকে সোজা জলিদার কাছে।
ভেবে নিয়েছিলাম, পার্টি সূত্রে জলিদার কাছে নিশ্চয়ই রিপোর্ট যাবে। তার চেয়ে আমিই বলে দিই সরাসরি। জলিদা কিন্তু ফেলে রাখেননি। সঙ্গে সঙ্গেই অন্য একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এটাই মানুষটার বিশেষত্ব। সিদ্ধান্ত নিতেন দ্রুত। কলকাতায় ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময়ে কী ভাবে শ্রমিকদের নিয়ে মহল্লা পাহারা দিতেন, সেই গল্পও শুনেছি। মুসলিম লিগ যে দিন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দিয়েছিল, সেই ১৬ অগস্ট তৎকালীন পোর্ট ট্রাস্ট কর্মী অ্যাসোসিয়েশনের মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিলেন জলিদারা। ময়দান এলাকায় পৌঁছতেই তাঁরা দেখতে পান, তত ক্ষণে কলকাতার রাজপথে লাশ পড়তে শুরু করেছে। দ্রুত মিছিল বাতিল করে মহল্লায় শান্তিরক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁরা। পরে জলিদাই সে সব ঘটনার কথা সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
সেই বালিগঞ্জের পার্টি অফিসের ঘটনা নিয়ে পরে কাউকে কিছু বলেছিলেন কি না, জানি না। তবে বিপ্লব দাশগুপ্তের সঙ্গে ওঁর ভাল সম্পর্ক ছিল। উনি এক বার জলিদাকে বলতে গিয়েছিলেন আমাকে পার্টিতে মেম্বার করার কথা। জলিদা বলেছিলেন, বিমান তো মেম্বার! ওকে কাজ দিয়েছি। বিপ্লবদা আমার কাছে পরে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কেন এটা ওঁকে বলিনি। আমার উত্তর ছিল, আপনি তো জিজ্ঞেস করেননি! তখন অত জানান দেওয়ার চল ছিল না। কিছু হলেই ঢাক পেটাতে হত না। যাঁরা যেটা জানার, জানতেন। জলিদা যেমন জানতেন, কলকাতায় কাকে কোথায় কোন কাজ দেওয়া আছে।
আমরা শুনতাম, জ্যোতি বসুর সঙ্গে জলিদার খুব ভাল সম্পর্ক। আমরা ছাত্র রাজনীতিতে সবে হাত পাকাচ্ছি তখন। তার পরে ধীরে ধীরে পার্টিতে। ওঁরা তখন প্রতিষ্ঠিত নেতা। ওই সময়ে দু’জনকে নিয়ে প্রত্যক্ষ কোনও ঘটনার সঙ্গে আমার যোগ ছিল না। তবে আমার মেম্বারশিপের সময়ে যে রেড কার্ড পেয়েছিলাম, তাতে সই ছিল জ্যোতিবাবুর। আর জেলা কেন্দ্র থেকে মেম্বারশিপ ট্রান্সফার করার সুপারিশ করে দিয়েছিলেন জলিদা। সব কিছু থেকে জলিদা দূরে চলে যাওয়ার পরে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে অবশ্য তাঁর দেখা হয়েছিল।
সেই ১৯৬২ থেকেই পার্টির মধ্যে বিতর্ক বাড়তে লাগল। নানা টানাপড়েন। তার পরে ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হয়ে গেল। আমরা সিপিএম-এ এলাম। জলিদা আসেননি। সেই সময়ের পর থেকে দুই কমিউনিস্ট পার্টির কোনওটার সঙ্গেই সরাসরি আর যুক্ত থাকতে চাননি জলিদা। তবে নানা বিষয়ের খোঁজখবর রাখতেন। আমরা ‘মেজরিটি’ হওয়ার পরে ৮০ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডের পার্টি অফিসটাও আমাদের কাছে চলে এসেছিল। সেখানে মণিদি (প্রয়াত কমিউনিস্ট নেত্রী এবং প্রাক্তন বিধায়ক মণিকুন্তলা সেন, জলি কলের স্ত্রী) আসতেন, জলিদা তেমন একটা আসতেনও না। আস্তে আস্তে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল তার পর থেকেই। কয়েক দিন আগে জলিদার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে দেখলাম, এখনকার সিপিআইয়ের অনেক নেতাও ওঁর সম্পর্কে জানেন না। আমার কাছে জানতে চাইছিলেন। সেই ষাটের দশক থেকে যে মানুষটা আর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেই, তাঁর সম্পর্কে পরবর্তী কালের নেতা-কর্মীরা জানবেনই বা কী করে?
জলিদা-মণিদি, এঁরা একটা বিগত জমানার প্রতিনিধি। মণিদি চলে গিয়েছেন অনেক আগেই। সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি, সে সময়ে রাজনীতিতে মহিলাদের সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এই রকম একটা বক্তব্য মণিদির ছিল। উনি কী বলেছিলেন, কী পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, জানি না। তবে আমি যতটুকু বুঝি, মণিদি তো গুরুত্ব পেয়েছেন। সেই আমলে কমিউনিস্ট পার্টি, সংগঠনে তাঁর যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বাধা-বিঘ্ন নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু মণিদি, ইলা মিত্র, কনক মুখোপাধ্যায় বা পরবর্তী কালে অনিলা দেবী— যাঁরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তাঁরা রাজনীতিতে গুরুত্ব পেয়েছেন।
কড়েয়ার হাউজ়িং-এ জলিদা থাকতেন। অনেক দিন আগে গিয়েছি। সাম্প্রতিক কালে এক বার ফোনে কথা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, শতবর্ষ আসছে ওঁর। এক বার গিয়ে দেখে আসব। যাওয়া আর হয়ে উঠল না। জলিদাই চলে গেলেন।
অনুলিখন: সন্দীপন চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy