একা ভ্লাদিমির পুতিন মহাশয়ই প্রমাণ, বলশেভিক বিপ্লবটি কী বিপুল ব্যর্থতার নজির। প্রায় একা হাতে, একক ক্ষমতাদৃপ্ততায় তিনি নিশ্চিত করিতেছেন, ১৯১৭ সালের ৬-৭ নভেম্বরের কথা যেন ২০১৭ সালের নভেম্বরে তাঁহার দেশময় কেবল এক ভাবেই প্রতিফলিত হয়: ভ্রান্তি, অতি ভয়ংকর ভ্রান্তি। তাঁহার কড়া অনুজ্ঞা, কোনও অনুষ্ঠান নয়। উত্তরে পারিষদগণ নতমস্তকে বলিয়াছেন, ‘ঠিক ঠিক’। এই বাহ্যিক অস্বীকৃতির অন্তরালে একটি গভীরতর বাস্তব লুকাইয়া। পুতিনের রাশিয়া আজ বহু অর্থে বলশেভিক-উত্তর সোভিয়েট ইউনিয়নের ‘কাউন্টারপয়েন্ট’, সাড়ম্বরে তাহা ধনতন্ত্রের বিশ্বের ক্ষমতাদৌড়ে শামিল। সেই রাশিয়া সরবে ঘোষণা করে, ১৯১৭ সালের অপেক্ষা ১৯৮৯ সাল বহু গুণ গুরুতর, প্রথমটি তাঁহাদের দেশকে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তিতে লইয়া গিয়াছিল, দ্বিতীয়টি তাহার উদ্ধার করিয়াছে। রুশ কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের চৌহদ্দির বাহিরে, প্রেসিডেন্ট ও ক্রেমলিনের আদেশ অনুসারে তাবৎ দেশবাসীর অনুভূতিও যদি এমনই হয়, বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন সত্যই অর্থহীন, বিপজ্জনকও বটে। ইহা যে একটি ঐতিহাসিক ভুল, নিকট অতীত তাহা প্রমাণ করিয়াছে, আর ঘটমান বর্তমান তাহাকে ধিক্কার দিতেছে। এক শত বৎসর আগের রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকারের তীব্র উত্তেজনায় শতসহস্র প্রজ্বলিত মুখের যে সকল ছবির সঙ্গে বিশ্বের একাধিক প্রজন্ম পরিচিত, তাহারা ইতিহাসের এই ভবিতব্যতা জানিত না। যে উদ্দেশ্য সাধনের আশায় তাহাদের মুখগুলি জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, সে সাধন ঘটে নাই, ঘটিবার কথাও ছিল না।
এই অবধি নিশ্চিত ভাবে বলিবার পর, কতগুলি অনিশ্চিত প্রশ্ন রহিয়া যায়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ব্যর্থ, তাহার পথ ভ্রান্ত। কিন্তু পুতিন যেমনটি বিশ্বাস করাইতে চাহেন, বলশেভিক বিপ্লব কি কেবল বলপূর্বক রাষ্ট্র অধিগ্রহণের নীতিটির বাহিরে এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে নাই, যাহা বিপুলাকার ব্যর্থতার ভারের নীচে এখনও প্রাসঙ্গিক? এক শত বৎসর পর নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ঘটনার দিকে ফিরিয়া তাকাইলে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া জরুরি। জারতন্ত্রের অবসান ঘটাইয়া সাধারণ মানুষের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রণের গণতান্ত্রিক স্বপ্নটি অচিরে অলীক প্রমাণিত হইয়াছে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতাতন্ত্রের হাতে স্বপ্নদর্শী অসহায় মানুষগুলি নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, বিরাট দেশে গৃহযুদ্ধের রক্তপ্লাবন বহিয়াছে, স্বাধীন ভাবনার কণ্ঠ রোধ করিয়া নির্বাসন ও নিধনের রেকর্ড তৈরি হইয়াছে, এবং সর্বাপেক্ষা বড় কথা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের সম্ভাবনা সমূলে নষ্ট করিয়া অসাম্য আরও অস্বচ্ছ, দুর্নীতিময় ও সন্ত্রাসময় হইয়াছে: সবই ঐতিহাসিক তথ্য। অথচ সতর্ক ঐতিহাসিক মূল্যায়ন বলিবে, বিপ্লবের মুহূর্তটিতে এই পথ ও এই ভবিতব্য কাঙ্ক্ষিত ছিল না। উদ্দেশ্যের নিহিতার্থ ও উদ্দেশ্যসাধনের পথ— অর্থাৎ লক্ষ্য ও পন্থাকে আলাদা করিলে পরবর্তী বিশ্বের জন্য হয়তো কিছু বার্তা রাখিয়া গিয়াছিল সেই দিনের বিপ্লব।
বার্তাটি সহজ নহে। রাশিয়া ও চিন উভয়েই নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সীমায় আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি কয়েক দশকব্যাপী পশ্চাৎপদতার দাম চুকাইতে ব্যস্ত। তবু এ কথা ঠিক, সাম্য-স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দুনিয়ার ছোট-বড় নানা দেশে সমাজতন্ত্রের ভাবধারাকে শক্তিশালী করিয়াছে, ঔপনিবেশিক সমাজগুলিকে প্রভাবিত করিয়া সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটিতে দেখিয়াছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের প্রয়োজনীয়তা, সেই সাম্য প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ভূমিকা, রাষ্ট্রের সেই ভূমিকার সম্ভাব্য ধরনধারণ— এই সব জিজ্ঞাসা কিন্তু বিপ্লবের উত্তরাধিকারও বটে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয় নাই, কিন্তু বিপ্লবের ছায়াটি তাহার মূল প্রশ্নের উত্তরের জন্য আজও প্রতীক্ষারত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy