রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর সামনেও লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন ইলিনা সেন।
সন্ধ্যার অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে টেলিভিশন ক্যামেরার সঙ্গে থাকা ফ্ল্যাশ লাইটে। সংবাদমাধ্যম দৌড়চ্ছে রায়পুর সেন্ট্রাল জেলের গেটের দিকে। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি। রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাসের কন্ডাক্টরও চাপড় মেরে বাস দাঁড় করিয়ে জানতে চাইছেন, “ডক্টর সাব নিকাল গ্যায়া?”
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্ত হয়েছেন মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অভিযুক্ত চিকিৎসক বিনায়ক সেন। গেট থেকে বিনায়ক বেরনোমাত্র কাছে এগিয়ে গেলেন তাঁর অশীতিপর মা অনসূয়া সেন। ঠিক এই সময়েই একটি টিভি চ্যানেলের বুম অনসূয়ার কপালে লাগল। বিনায়ক সেন দ্রুত মা’কে জড়িয়ে আগলে নিয়ে বললেন, “মা, তোমার লাগেনি তো?” মৃদু হেসে বৃদ্ধা বলেন, “না।” কিন্তু এমন এক মুহূর্তে বিনায়কের স্ত্রী ইলিনা সেন কোথায়? কিছু ক্ষণ আগেও তো তাঁকে দেখেছি!
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ নিম্ন আদালতে ও জেল কর্তৃপক্ষের কাছে এসে পৌঁছনোর প্রতীক্ষায় দিনভর কাটিয়েছেন তিনি। এ দিক-ও দিক তাকাতে তাকাতেই চোখে পড়ে তাঁকে। রায়পুর সেন্ট্রাল জেলের সামনের চত্বরের গেটের কাছে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। ইলিনার দৃষ্টি নিবদ্ধ দূরে বিনায়কের দিকে। বাঁধভাঙা অশ্রুধারা বয়ে চলেছে দু’চোখ দিয়ে। ধীর পায়ে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জানতে চাই, আপনি সামনে যাবেন না? অস্ফুটে ইলিনার জবাব আসে, “আজ আমার সামনে যাওয়ার দিন নয়।”
অথচ বাইরের পৃথিবী জানে, জেলবন্দি বিনায়ককে মুক্ত করতে কী অক্লান্ত পরিশ্রমটাই না করেছিলেন ইলিনা সেন (ছবিতে)। সঙ্গে আরও অনেক মানুষ ও সংগঠনকে তিনি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু একেবারে সামনে থেকে সেই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। তার অনেক আগে থেকেই ক্যানসার তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত স্বামী। অতএব, রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর সামনে তাঁকে পড়তে হয়েছে নিরন্তর। শুনতে হয়েছে হুমকি, ভয় দেখানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন ইলিনা।
আদ্যন্ত সমাজকর্মী, নারীদের, বিশেষ করে প্রান্তিক নারীদের ক্ষমতায়নের পক্ষে আজীবন লড়াকু এক সেনানী ইলিনা। ছত্তীসগঢ়ের খাদান শ্রমিক মেয়েদের জন্য দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। সেই আশির দশকের গোড়ায় বিনায়কের সঙ্গে তিনিও শামিল হয়েছিলেন ছত্তীসগঢ় মুক্তি মোর্চার নেতা শঙ্কর গুহনিয়োগীর শহিদ হাসপাতালের বিপুল কর্মযজ্ঞে। ছত্তীসগঢ় মাইনস শ্রমিক সংগঠনের গড়া সেই শহিদ হাসপাতাল সারা দেশের নজর কাড়ে তার আদর্শের জন্য। খাদান শ্রমিকদের নিয়ে লড়াইয়ে তাঁদের স্বাস্থ্যের আন্দোলনের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর ছিল শঙ্কর গুহনিয়োগীর। এই কাজেই তিনি পাশে পান শৈবাল জানা, আশিস কুণ্ডু, চঞ্চলা সমাজদার, পুণ্যব্রত গুণ, বিনায়ক সেনের মতো চিকিৎসকদের ও ইলিনা সেনের মতো সমাজকর্মীকে। এই স্বেচ্ছাসেবীরা বেতন পেতেন না বটে, কিন্তু তাঁদের খাবারদাবারের দায়িত্ব ছিল ইউনিয়নের হাতে। চলত ‘কমিউনিটি কিচেন’। উৎসব-অনুষ্ঠান বা এমনি সময়েও খাদান শ্রমিকেরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। ফলে শ্রমিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, বিশেষ করে খাদানের মেয়েদের অভাব-অভিযোগ বা তাঁদের স্বাধিকারের লড়াইয়ে শামিল হতে দেরি হয়নি ইলিনার।
তাঁর ইনসাইড ছত্তীসগঢ়/ আ পলিটিক্যাল মেমোয়ার গ্রন্থে সেই পর্বের উল্লেখ করেছেন ইলিনা। তাঁর বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, তিনি একেবারে খাদান শ্রমিক মহিলাদের মাঝে থেকে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, যাতে তাঁরা আলাদা করে লড়তে পারেন, পুরুষদের উপরে নির্ভরতা কমাতে পারেন। ১৯৮৭ সালে তিলদার এক হাসপাতালে যোগ দেন বিনায়ক। সেই লড়াইয়েও শামিল ছিলেন ইলিনা।
প্রান্তিক নারীদের সংগ্রাম ও তাঁদের ক্ষমতায়ন নিয়ে ইলিনার আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আ স্পেস উইদিন দ্য স্ট্রাগল/ উইমেন’স পার্টিসিপেশন ইন পিপল’স মুভমেন্টস।
এই দম্পতি ‘রূপান্তর’ নামে যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি করেন, সেই সংস্থা আদিবাসীদের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কৃষকদের জন্য বীজ সংরক্ষণ এবং মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছে। ছত্তীসগঢ়ের ধমতেরি জেলার বাগরুম নালা এলাকায় ‘রূপান্তর’-এর কর্মকাণ্ড।
প্রথমে ওয়ার্ধার ‘মহাত্মা গাঁধী অন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়’ ও পরে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর ‘অ্যাডভান্সড সেন্টার ফর উইমেন’স স্টাডিজ়’-এ অধ্যাপনা করেছেন ইলিনা। আদিবাসী ও প্রান্তিক মেয়েদের লড়াইয়ের কাহিনি তুলে এনেছেন শিক্ষার আঙিনায়। নিরন্তর লেখালিখি, সেমিনার ও গবেষণার মাধ্যমে গোটা বিষয়টিকে দিয়েছেন আন্তর্জাতিকতার মোড়ক।
গণতন্ত্রের ভাঁড়ারে বিরুদ্ধ স্বর আজ বাড়ন্ত। এই সময়ে এ ভাবে ইলিনা সেন চলে গেলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মস্ত ক্ষতি হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy