শান্তিনিকেতন আবার অশান্ত। আমরা জানি, বৃহত্তর অর্থে শান্তিনিকেতন এক বড়, সমৃদ্ধ পল্লি। তবে তার ভাল-মন্দ, আনন্দ-আপত্তি মূলত বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে। তাই বিশ্বভারতীর যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ বৃহত্তর শান্তিনিকেতনের উপর প্রভাব ফেলে। এখন মেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরার ব্যাপারেও সেটাই ঘটছে।
কিন্তু, শুধু সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে সামগ্রিক ভাবে বিশ্বভারতীর দিকেও একটু তাকানো বোধ হয় জরুরি। কারণ তাতে একটা ধারাবাহিকতা বোঝা যেতে পারে। তবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা, মুক্ত চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার জন্য প্রাজ্ঞ পণ্ডিতজনেরা আছেন। এখানে চেষ্টা থাকবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক জন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে শান্তিনিকেতনের ভিতরের ও বাইরের বদলটি দেখার।
রবীন্দ্রনাথের হাতে যখন শতবর্ষ প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়, তখন থেকেই বিস্তীর্ণ, খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে নিছক বই-পড়া শিক্ষার বাইরে মনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ছিল বিশ্বভারতীর শিক্ষাধারার অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৫১ সালে এটি কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরেও রবীন্দ্র-ভাবনায় ঘা পড়েনি।
বরং অনেকের অনেক কটাক্ষ, উন্নাসিকতা, সমালোচনা সত্ত্বেও বিশ্বভারতী তার এই অনন্য চরিত্রটি এত দিন বজায় রেখে চলেছে। বাংলাও তার শ্রদ্ধা, আবেগ এবং রবীন্দ্র-প্রীতি দিয়ে তাকে আগলে রেখেছে। দেশের আর দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্ষমতাসীনদের তুঘলকি শান্তিনিকেতনের এই শিক্ষাঙ্গনে দাঁত-নখ ফোটালে তাই কলরব তীব্র হয়। প্রতিবাদেরও ভৌগোলিক সীমানা থাকে না।
এ কথা ঠিক, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় দেশের শাসক দলের কিছু প্রভাব সর্বদাই এখানে থাকে। কংগ্রেস আমলেও বিশ্বভারতী পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে কেন্দ্রীয় শাসকদের ঘনিষ্ঠ ও বশংবদদের ভিড় বেড়েছে। তবে কোথাও একটা সৌজন্যের পাঁচিলও ছিল। ফলে ব্যক্তিভিত্তিক ও পারস্পরিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি বিষিয়ে যেত না। তার চেয়েও বেশি ছিল একটা সহমর্মিতার বাতাবরণ।
নেহরু, ইন্দিরা গাঁধীর আমল ছেড়েই দিলাম। রাজীব গাঁধীর আমলেও তৎকালীন বিশ্বভারতীতে বিক্ষোভ দেখেছি। রাজ্যে তখন সিপিএমের একচ্ছত্র দাপটের কাল। উপাচার্য নিমাইসাধন বসু তখন বহু বার ঘেরাও, বিক্ষোভের শিকার হয়েছেন। প্রশাসনিক ভবনের গেট আটকিয়ে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছে। উপাচার্য অভিযোগে সরব হয়েছেন। পরেও ছোট-বড় দাবিদাওয়া, বিক্ষোভ, প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়েছে সব্যসাচী ভট্টাচার্য, রজতকান্ত রায়, সুশান্ত দত্তগুপ্ত— সকলকে। কিন্তু তার জন্য যুদ্ধং দেহী? বদলা নিতে ‘প্রতিপক্ষ’ বাহিনী লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনা? কথায় কথায় শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা? হয়েছে কি? বোধ হয় নয়।
এখন তো শুনতে পাই, প্রজাতন্ত্র দিবসে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বক্তৃতার ভিডিয়ো ক্লিপ প্রকাশ করার জন্য হস্টেল থেকে বিতাড়িত হয়েছেন এক পড়ুয়া! অভিযোগ, ওই বক্তৃতায় উপাচার্য সংবিধান বিষয়ে যে সব কথা বলেছিলেন, পড়ুয়াটি তা প্রচার করায় সমাজমাধ্যমে উপাচার্য ‘সমালোচিত’ হয়েছেন। অতএব ‘অপরাধ’ বড়ই গর্হিত!
বিদ্যুৎবাবুর জমানায় গত বছর দুয়েকে অধ্যাপক-ছাত্র-কর্মী সব মিলিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার চিঠিই নাকি ধরানো হয়েছে শ’খানেক! উপাচার্য অবশ্য নিয়মিত ‘বার্তালাপ’ নামক প্রচারপত্র মারফত ব্যাখ্যা করে থাকেন, বিশ্বভারতীর অন্দরে ‘অরাজকতা’ কী ভাবে শিকড় বিছিয়েছে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি কত সচেষ্ট।
কিন্তু শাস্তি হলেই কি ‘সোয়াস্তি’ মেলে! জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান বিচারে (এনআইআরএফ) রবীন্দ্র-ভাবনায় ঋদ্ধ বিশ্বভারতী সদ্য এক ধাক্কায় ৩৭ থেকে ৫০-এ নেমেছে। উপাচার্য নিজেই জানিয়েছেন, কর্মসচিব এবং বিত্তাধিকারিকের মতো দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি নিজের পরিচিতদেরও রাজি করাতে পারেননি! এখনও দুই পদেই অস্থায়ীরা।
কর্মসমিতিতে বিশ্বভারতীর পরিদর্শক অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য সুজিত ঘোষের অভিযোগ, এখন কোনও কিছু আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। সিদ্ধান্ত ‘তৈরি’ হয়েই আসে। কর্মসমিতিতে তা কার্যত শুনিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগের সত্যাসত্য তর্কসাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু এক জন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন প্রকাশ্যে এমন কথা বলেন, তখন তা এক বাক্যে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।
এ তো গেল অন্দরের অবস্থা। বহিরঙ্গের মুখচ্ছবি আরও নিদারুণ। বস্তুত সেই আলোচনায় খানিকটা বোঝা যেতে পারে পাঁচিল-মানসিকতাও। সোজা কথায় যার মূল সুর হল, ওরা থাকুক ও ধারে!
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে রাজনীতির বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। চিঠিপত্রে ও অন্যত্র বার বার তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীরা রাজনীতি-সচেতন হবেন না, তা নয়। কিন্তু এই শিক্ষাঙ্গনে তার ছায়াপাত অনভিপ্রেত। সন্দেহ নেই, ছাত্র-রাজনীতির ‘সৌজন্যে’ তাঁর সেই চাওয়া বহু আগেই নিষ্পেষিত। যে কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই এখানেও রাজনীতি গভীর বাসা বেঁধেছে।
কিন্তু বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নিজেরা রাজনীতির খেলায় শরিক হয়ে উঠলে বিষয়টি গুরুতর মাত্রা পেতে বাধ্য। দুর্ভাগ্য, আজকের বিশ্বভারতী সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। বর্তমান উপাচার্যের কিছু কিছু পদক্ষেপই তার প্রমাণ।
গত জানুয়ারির ঘটনাটি হয়তো অনেকেই ভোলেননি। তবু একটু মনে করিয়ে দিই। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ যখন তুঙ্গে, তখনই বিজেপি-ঘনিষ্ঠ এক রাজ্যসভা সদস্যকে এনে ওই আইনের পক্ষে বক্তৃতা করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন উপাচার্য বিদ্যুৎবাবু। প্রশ্ন উঠেছিল, বিপক্ষের মতামত প্রকাশের সুযোগই বা তা হলে থাকবে না কেন? বিশ্বভারতী কি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কেন্দ্রীয় শাসক দলের অভিমত প্রচারের মঞ্চ হয়ে কাজ করতে পারে?
সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের বক্তৃতা পণ্ড করা নিয়ে পড়ুয়াদের দু’পক্ষের মধ্যে এর পরে পেশিযুদ্ধ বাধে। সভা রুখতে স্বপনবাবুকে কয়েক ঘণ্টা ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। পাল্টা হিসেবে হস্টেলগুলিতে চড়াও হয়ে সভা-সমর্থকরা পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল বিরোধী ছাত্রদের, যার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দায় উপাচার্য এড়াতে পারেন না।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়ো ক্লিপিং থেকে। যা ওই সভার আগের সন্ধ্যায় বিশ্বভারতীর ডাকা মোমবাতি মিছিল থেকে সংগৃহীত বলে দাবি। তাতে দেখা যায়, মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে পাশের এক জনকে উপাচার্য বলছেন, “কালকে একটু এসো।… সাড়ে তিনটের সময়। যা দেখছি, ওরা বদমাইশি করার চেষ্টা করবে।… তোমাদের বাইক বাহিনী নিয়ে এসো…।” বিশ্বভারতীর দাবি, ওটি সাজানো। ঘটনাপরম্পরা কিন্তু অন্য কথা বলে।
সে দিনের মোমবাতি মিছিলের কারণ দু’টিও ছিল চমকপ্রদ! প্রথমত, নির্ধারিত দিনের পরেও পৌষমেলার মাঠে স্টল রাখার জন্য স্বয়ং উপাচার্য তাঁর লোকদের নিয়ে স্টল ভাঙতে নেমেছিলেন। তখন এক মহিলা স্টলমালিক তাঁর সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করার অভিযোগ আনেন। মিছিল ছিল সেই ‘কুৎসা’ রটনার প্রতিবাদে। দ্বিতীয়ত, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ মেলায় পরিবেশবিধি লঙ্ঘনের জন্য বিশ্বভারতীকে দশ লক্ষ টাকা জরিমানা করে। তাই কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী মিছিল ডেকেছিল রাজ্য সরকারের ওই সংস্থার বিরুদ্ধে। এমন নজির মেলাও সত্যি দুষ্কর! এটা কি কোনও উপাচার্যের উপযুক্ত ভূমিকা হতে পারে?
এর পরেও যদি কেউ বলেন, বিশ্বভারতীর বর্তমান কর্তৃপক্ষ সচেতন ভাবে রাজনীতি আমদানি করছেন না, তা হলে তাঁদের দৃষ্টির স্বচ্ছতা এবং মনন নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকবেই।
উপাচার্যের এক একটি ‘বার্তালাপ’ দেখলেই বোঝা যায়, সমস্যার বীজ লুকিয়ে রয়েছে মানসিকতায়। মেলার মাঠ পাঁচিলে ঘেরা বা শান্তিদেব ঘোষ, অমর্ত্য সেন প্রমুখের বাড়ি আড়াল করে দেওয়াল তোলা সেখানে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। বসুধাকে ক্রমাগত খণ্ড, ক্ষুদ্র করতে চাওয়ার পরিণামে বিশ্বভারতীর শিক্ষক-ছাত্র-কর্মীদের একাংশ থেকে শুরু করে আশ্রমিক, প্রাক্তনী, এমনকি প্রতিবেশী বোলপুরের একটি বড় জনসমষ্টিও যেন আজ বিশ্বভারতীর ‘শত্রু’!
চোখে দেখা দু’-চারটে দেওয়ালের চেয়ে অন্তরে গড়ে ওঠা এই অচলায়তনের প্রাচীর অনেক বড় বাধা। সেটা আগে ভাঙা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy