Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

পথনির্দেশ

কেবল ব্রিটেনে নহে, সাধারণ ভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের কী ভাবে চলা উচিত, সেই বিষয়ে নির্দেশিকা হিসাবে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়টি মূল্যবান।

পার্লামেন্ট সাসপেন্ডকে ‘বেআইনি’ ঘোষণা ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের

পার্লামেন্ট সাসপেন্ডকে ‘বেআইনি’ ঘোষণা ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০২
Share: Save:

ব্রেন্ডা হেল ও তাঁহার সহ-বিচারকরা স্বদেশের মান রাখিয়াছেন, মান রাখিয়াছেন সংসদীয় গণতন্ত্রের। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘সকল পার্লামেন্টের জননী’ বলিয়া পরিচিত। তাহা কেবল বয়সের কারণেই নহে, ঐতিহাসিক বিবর্তনের কারণেও। গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা, দুর্বলতা এবং সামর্থ্য, বিবিধ বাধাবিপত্তি এবং সেই বাধাবিপত্তি অতিক্রম করিয়া উত্তরণের শক্তি— এই সমস্ত কিছুই ব্রিটিশ সংসদীয় ইতিহাসের পর্বে পর্বে উন্মোচিত হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আপন দেশের গণতন্ত্রকে নূতন পরীক্ষায় ফেলিয়াছিলেন। যেন তেন প্রকারেণ অক্টোবরের মধ্যেই ব্রেক্সিট সারিয়া ফেলিবার তাড়নায় তিনি শেষ অবধি আইনসভার অধিবেশন স্থগিত রাখিয়া (প্রোরোগ) বসিয়াছিলেন, যাহাতে আইনসভায় তাঁহার ব্রেক্সিট-নীতি অনুমোদন করাইয়া লইবার আর প্রয়োজন না থাকে। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত মামলায় ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টের এগারো জন বিচারপতি সর্বসম্মত রায় দিয়াছেন: প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বেআইনি। সর্বোচ্চ আদালতের প্রেসিডেন্ট ব্রেন্ডা হেল জানাইয়া দিয়াছেন: সিদ্ধান্তটি অ-কার্যকর (ভয়েড), সুতরাং আইনের বিচারে পার্লামেন্টের অধিবেশন আদৌ বন্ধ হয় নাই। বরিস জনসন এই রায়ের সহিত ‘সম্পূর্ণ ভিন্নমত’ পোষণ করিলেও তাহা মানিয়া লইয়াছেন। তাঁহার অন্য উপায় ছিল না।

কেবল ব্রিটেনে নহে, সাধারণ ভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের কী ভাবে চলা উচিত, সেই বিষয়ে নির্দেশিকা হিসাবে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়টি মূল্যবান। দীর্ঘ এবং অসামান্য যুক্তিপরম্পরায় স্তরে স্তরে বিন্যস্ত সেই নির্দেশিকার মূল সূত্র দুইটি: এক, সরকার তথা শাসনবিভাগ তাহার ক্ষমতার অতিব্যবহার করিয়া সংসদ তথা আইনবিভাগের প্রতি আপন দায়বদ্ধতার শর্ত লঙ্ঘন করিবে না; দুই, সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত সেই শর্ত লঙ্ঘন করিয়াছে কি না তাহা নির্ধারণ করিবে বিচারবিভাগ। স্পষ্টতই, এই দুই সূত্রের সমন্বয়েই নিহিত আছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ভারসাম্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এই তিন বিভাগ কী ভাবে পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের (‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’) শৃঙ্খলায় ধরিয়া রাখে, তাহা সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করিয়া বলা আছে। ওয়েস্টমিনস্টার মডেলে এই প্রক্রিয়া তুলনায় প্রচ্ছন্ন এবং সূক্ষ্ম, কিন্তু তাহার গুরুত্ব কোনও অংশে কম নহে।

ভারতের শাসনতন্ত্র সরাসরি ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সন্তান, যদিও তাহাতে অন্য একাধিক দেশের সংবিধান হইতে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের সংযোগ ঘটিয়াছে। ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়টির মূল বক্তব্য এই দেশের পক্ষেও প্রাসঙ্গিক। শাসনবিভাগের আপন ক্ষমতা অতিব্যবহারের নজির এই দেশে বিস্তর। জরুরি অবস্থার চরম পর্ব তো আছেই, সাধারণ অবস্থাতেও অধ্যাদেশ মারফত সংসদকে এড়াইয়া অথবা সংসদীয় বিতর্ককে কার্যত পাশ কাটাইয়া গুরুতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার প্রবণতা নাগরিকদের অতি পরিচিত। এই ধরনের অবাঞ্ছিত ও বিপজ্জনক প্রবণতা বর্তমান জমানায় কোনও অংশে কমে নাই, বরং তাহার অভিযোগ বাড়িয়াই চলিয়াছে। অনেক ক্ষেত্রেই সেই অভিযোগের জবাবে শাসকরা প্রত্যক্ষ ভাবে বা প্রকারান্তরে বলিয়া থাকেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং সুশাসনের প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার শাসনবিভাগের আছে। ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুসরণ করিয়া মনে করাইয়া দেওয়া আবশ্যক যে, বিশেষ ক্ষমতার (প্রিরোগেটিভ পাওয়ার) প্রয়োগ যেন কখনওই সংসদের অধিকার এবং কর্তব্যের পথে বাধা হইয়া না দাঁড়ায়। স্পষ্টতই, এই আদর্শের প্রয়োগবিদ্যাটি জটিল, প্রয়োগ যথাযথ কি না তাহার বিচারও অনেক সময়েই সূক্ষ্ম। সেখানেই বিচারবিভাগের নজরদারির অপরিসীম গুরুত্ব। মহামান্য বিচারপতিদের নিকট ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাশা এবং দাবিও অপার।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy