সেই ১৯৬৮ সালে রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং-এর হত্যার পর যে বিশাল জনরোষ আমেরিকার বিবেককে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল, আজ আরও এক বার যেন সেই জনরোষের প্রতিচ্ছবি। এই ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যসঙ্কটের মধ্যেও লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব অগ্রাহ্য করে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমেছেন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের ওপর পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে। মিনিয়াপোলিসে নিরস্ত্র ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে সশস্ত্র পুলিশ অফিসারের মেরে ফেলার ছবি এখন সারা পৃথিবীতে ভাইরাল। বিশ্বের সর্বত্র মানুষ এই আমেরিকাকে দেখে স্তম্ভিত।
প্রতিবাদে আমেরিকায় তীব্র জনরোষ— মিনিয়াপোলিস থেকে শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, পশ্চিমে লস এঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকো, দক্ষিণে হিউস্টন ও ডালাস, এমনকি ছোট শহরেও, যেখানে পুলিশি অত্যাচার ও হত্যার ঘটনা বহু বার ঘটেছে। এর মধ্যে আছে সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লস্টন, যেখানে ২০১৪ সালে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক মাইকেল ব্রাউনকে পুলিশ গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছিল। আছে নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস, যেখানে আফ্রিকার গিনি থেকে পড়াশোনা করতে আসা যুবক আমাদু দিয়ালোকে বিনা কারণে পুলিশ রাতের অন্ধকারে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। আছে নিউ ইয়র্কের কুইন্স, যেখানে বিয়ের আগের রাতে ব্যাচেলর্স পার্টি করে বেরনোর সময় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক শন বেলকে পুলিশ সাবমেশিনগান চালিয়ে শেষ করে দিয়েছিল। এক ২০১৫ সালেই আমেরিকার পুলিশ একশোর বেশি নিরস্ত্র মানুষকে খুন করেছে।
আমেরিকার কালো মানুষরা চারশো বছর ধরে অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন। দুশো বছর শিকার হয়েছেন দাসপ্রথা নামের বর্বর প্রথাটির, আর আরও একশো বছর ধরে তীব্র বর্ণবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের। তাঁদের মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে নিষ্ঠুর ভাবে। দক্ষিণ ইলিনয় অঞ্চলে পাঁচ বছর বাস করার সুবাদে দেখেছি, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের বাথরুম, এমনকি জলের কল পর্যন্ত আলাদা। মনে পড়েছে আমাদের দেশে জাতপাতের, উচ্চ ও নিম্নবর্ণের বীভৎসতার কথা।
আজকের আমেরিকায় এই জনরোষের আবহে হিংসা, লুটপাট ঘটনাও কিছু দেখা যাচ্ছে। যাবেই। মনে রাখতে হবে পরিস্থিতি। এ দেশের মানুষ এমনিতেই ঘোর দুর্দশায় ছিলেন। দু’মাসে আমেরিকায় এক লক্ষের বেশি মানুষ কোভিড-১৯’এ মারা গেছেন। চলেছে মৃত্যুমিছিল, শবদেহ গণকবর দেওয়া হয়েছে জায়গার অভাবে। মৃত্যুর সময়ে বা পরে শেষ বারের মতো দেখাও করতে পারছেন না প্রিয়জনেরা। মর্গের অভাবে বড় বড় রেফ্রিজারেটরে রেখে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার মৃতদেহ। বিশাল বিশাল ট্রাকে সেই সব মৃতদেহ ব্রুকলিনের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শেষকৃত্যের জন্যে। মানুষ ভেঙে পড়ছে, মানুষ রাগে ফুঁসছে।
এই এক লক্ষ মানুষের একটা বিরাট অংশই কৃষ্ণাঙ্গ। যাঁদের কথা আমেরিকার শাসক শ্রেণি ভাবে না। যাঁরা আজীবন দারিদ্র, অশিক্ষা ও কুস্বাস্থ্যের শিকার। যে অঞ্চলে তাঁদের বসবাস, সেখানকার পরিবহণ ব্যবস্থা হাস্যকর। তাঁদের এলাকায় সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ড্রাগের আসক্তিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে মানুষকে। তাঁদের হাউসিং প্রজেক্টে আমেরিকার সশস্ত্র পুলিশবাহিনী ঢুকে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও মানুষকে খুন করতে পারে— বিনা তদন্তে, বিনা বিচারে। নয়তো, টেনে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার মুনাফাভিত্তিক প্রাইভেট কারাগারে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে বাকি জীবনের জন্যে। যে প্রাইভেট জেল এখন আমাদের দেশেও নানা জায়গায় তৈরি হচ্ছে। ভয় হয় ভেবে, এই সাদৃশ্যগুলো কেবলমাত্র কাকতালীয় নয়।
হিংসা, লুটপাট, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আমেরিকার কোণে কোণে, শহর ও শহরতলিতে, রাস্তায় পার্কে বাজারে এই মুহূর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চলছে, তার পিছনে যে বিপুল জনসমর্থন, এও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই আমেরিকাই আমাদের চেনা আমেরিকা, যার জন্য গর্ব বোধ করা যায়।
মেমফিস শহরে মার্টিন লুথার কিং-এর হত্যার সময়ে তো এ দেশে ছিলাম না। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে জেনেছি, কী তীব্র শোক সেই সময় গ্রাস করেছিল এ দেশের বিবেকবান মানুষদের। শোকতাড়িত আন্দোলন সে দিনও মানুষকে রাজপথে এনে ফেলেছিল। সেই জনজোয়ারে কেবল কৃষ্ণাঙ্গরাই ছিলেন তা নয়। ছিলেন শ্বেতাঙ্গরাও। ঠিক যেমন দেখেছি, ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করার জন্যে লক্ষ লক্ষ আমেরিকানকে মাইনাস দশ ডিগ্রির হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় রাস্তায় নেমে সমাবেশ ও মিছিল করতে, যেমন দেখেছি ৯/১১’এর সন্ত্রাসী হামলার পরে দরিদ্র নির্দোষ অভিবাসীদের বিনা বিচারে টেনে নিয়ে গিয়ে কারাবন্দি করে রাখার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষকে রাস্তায় নামতে, যেমন দেখেছি সাম্প্রতিক কালের পরিবেশ ও জলবায়ু আন্দোলনে সমস্ত বর্ণের ও ধর্মের মানুষকে শামিল হতে।
আমেরিকার এই শুভবোধসম্পন্ন জনসমুদ্রের সাক্ষী থেকেছি। এই আমেরিকার কথা আমাদের দেশের মানুষ জানেন কি? জানা দরকার। কারণ সমস্ত ঘটনারই প্রতিচ্ছবি আজ আমাদের দেশেও।
জানা দরকার, এই অহিংস জনসমুদ্রের জোয়ার যে কোনও অত্যাচারী, মিথ্যাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসককে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে পারে। শুধু আবেগের কথা নয়, এই হল ইতিহাসের শিক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy