Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Phulmoni Dasi Rape Case

স্বামীর সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্ত

আর একটি মেয়ে, তারও বিয়ে হয় ন’বছর বয়সে। হিন্দু আইনের বিধানমতে এগারো বছর বয়সে তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় হয়। কিন্তু গররাজি হয় মেয়েটি— স্বামীর কাছে যেতে রাজি নয় সে।

রুকমাবাই

রুকমাবাই

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

১৮৮৯ সালে একটি ন’বছরের মেয়ের আর ত্রিশ বছরের স্বামীর দাম্পত্যের প্রথম রাতেই মারা যায় সেই মেয়েটি— যার নাম ফুলমণি দাসী। ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব আইন সেই ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে মনে রাখে ‘দ্য ফুলমণি দাসী রেপ কেস’ নামে।

আর একটি মেয়ে, তারও বিয়ে হয় ন’বছর বয়সে। হিন্দু আইনের বিধানমতে এগারো বছর বয়সে তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় হয়। কিন্তু গররাজি হয় মেয়েটি— স্বামীর কাছে যেতে রাজি নয় সে। স্বামী বয়সে খুব বেশি বড়ও নয়— ন’বছরের মেয়েটির বিয়ের সময় তার স্বামীর বয়স ছিল সতেরো। মা আর মায়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্বামীর সঙ্গে থাকে সে। মেয়েটির বাবা জনার্দন পান্ডুরং মারা যান, যখন তার মায়ের বয়স ষোলো। তারা সুথার সম্প্রদায়ের অংশ, বিধবা বিবাহ সেই সম্প্রদায়ে বহু কাল ধরে প্রচলিত। তাই স্বামীর মৃত্যুর ছ’বছর পরে আবার বিয়ে করেন মেয়েটির মা, জয়ন্তীবাই।

তার নতুন পিতা ডাক্তার সখারাম অর্জুন ছিলেন ব্যতিক্রমী। স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী ও নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাঁর উৎসাহেই মেয়েটির লেখাপড়া শুরু, ফ্রি মিশনারি চার্চের সহায়তায়। প্রার্থনাসমাজেও যাতায়াত শুরু করে সে। ন’বছর বয়সে ডা. অর্জুনের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গেই বিয়ে হয়— ছেলেটিকে মেয়েটির বাড়িতেই থাকতে হবে, এই শর্তে। এক বছর থাকেও মেয়েটির স্বামী, দাদাজি ভিকাজি। তার পর সেই শর্ত লঙ্ঘন করে ফিরে যায় তার নিজের বাড়িতে। হয়তো সে ফিরেও আসত না। কিন্তু নানা ভাবে দেনাগ্রস্ত হয়ে বিয়েতে না নেওয়া পণের কথা মনে পড়ে। তার স্ত্রীকে, সেই মেয়েটিকে ডেকে পাঠায় সে, কারণ বৌকে স্বামীর কাছে আসতে হলে আসতে হবে যথাযথ নিয়মে, পণ ও আদানপ্রদানের বিধি মেনে।

সেই মেয়েটির বয়স তখন এগারো বছর। সে বেঁকে বসে। তার পিতা ডাক্তার অর্জুন তাকে সমর্থন করেন। মার অসমর্থন সত্ত্বেও সে শ্বশুরবাড়ি না যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অনড় থাকে।

এর পর যা হয়, তা স্বাধীনতাপূর্ব ভারতের আইনের ইতিহাস মনে রেখেছে, ফুলমণি দাসীর মতোই। তার স্বামী ভিকাজি মামলা করেন তার বিরুদ্ধে। তৎকালীন ব্রিটিশ আইনের এক নিয়ম ছিল ‘রেস্টিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’— যেখানে স্ত্রী কোনও কারণ ছাড়া স্বামীর সঙ্গে না থাকলে, তা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই আইনের ভিত্তিতেই মামলা করেন ভিকাজি। দমে যায় না মেয়েটি। পিতার সমর্থনে সেও একটি মামলা করে— স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন যাপন না করার অনুমতি চেয়ে।

১৮৮৫ সালে, এখন থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে ইতিহাস তৈরি করা মেয়েটির নাম রুকমাবাই। শুধু স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন শুরুতে আপত্তি জানিয়ে আইনের পথে যাওয়া নয়, আইনের পরিবর্তন চেয়ে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় কলম ধরেন তিনি। লিখতেন ইংরেজি ভাষায়, ছদ্মনাম ছিল ‘দ্য হিন্দু লেডি’। টানা তিন বছর ধরে চলে সেই লেখা। এত জনপ্রিয় হয়, এত আলোড়ন ফেলে এই লেখা যে, তার সমর্থনে বিদেশের পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এবং ম্যাক্স মুলার।

দেশের রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে। হিন্দুত্ববাদী নেতারা মুখে স্বদেশি আন্দোলনের কথা বললেও, দেশের মেয়েটির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়েন। যেমন বালগঙ্গাধর টিলক ও বিশ্বনাথ নারায়ণ মণ্ডলিক। তাঁরা সংবাদপত্রে মতামত দেন, রুকমাবাই যা করছেন, তা হিন্দু ধর্মের এবং ভারতের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।

বম্বে হাইকোর্টে শুনানি চলে তিন বছর। ১৮৮৮ সালে হিন্দু আইন অনুসারেই ফয়সালা শোনানো হয়— রুকমাবাইকে স্বামীর কাছে যেতে হবে, নয়তো ছ’মাসের কারাদণ্ড মেনে নিতে হবে।

ছ’মাসের কারাদণ্ড মেনে নেন রুকমাবাই, তবু স্বামীর কাছে যেতে রাজি হন না। তাঁর পাশে থাকেন পিতা, এবং কিছু শুভানুধ্যায়ী। তাঁরা ‘রুকমাবাই ডিফেন্স ফান্ড’ তৈরি করে তাঁর আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।

রুকমাবাইয়ের গল্প জেলেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হয় না। রুকমাবাই জেল থেকে ছাড়া পান ১৮৮৯ সালে। সেই বছরই তিনি বিলেতযাত্রা করেন ডাক্তারি পড়বেন বলে। অর্থের জোগান দেয় ‘রুকমাবাই ডিফেন্স ফান্ড’। ১৮৯৪ সালে, কাদম্বিনী, আনন্দীবাই যোশীদের ঠিক আট বছর পরে, রুকমাবাই ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করেন। দেশে ফিরে এসে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৯২৯ সাল অবধি বিখ্যাত মহিলা ডাক্তার হিসেবে রাজকোট অঞ্চলে নিজের কাজ করে চলেন।

কাদম্বিনীকে মনে রেখেছি প্রথম মহিলা প্র্যাকটিসিং ডাক্তার বলে, এমনকি সেই সূত্রে আনন্দীবাই যোশীকেও। রুকমাবাইয়ের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে ইতিহাস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy