ছবি: সংগৃহীত
বীর্যসিংহ যে কয়েক দিনের জ্বরে বিদেশ-বিভুঁইয়ে এ ভাবে তাঁদের ছে়ড়ে চলে যাবেন, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি অতীশ। বীর্যসিংহের ভরসাতেই তো এই ষাট বছর বয়সে হিমালয় পেরিয়ে অচেনা তিব্বত দেশে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি।
বৌদ্ধ ভিক্ষু অতীশ বিক্রমশীলা মহাবিহারের উপাধ্যক্ষ, তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দেশজোড়া। পশ্চিম তিব্বতের গুজে রাজ্যের রাজা ‘ইয়েশে-ও’কে তিনি দেখেননি, নাম শুনেছেন মাত্র। ইয়েশে-ও পরম ধার্মিক, সে দেশে থোলিং নামে একটি মহাবিহার নির্মাণ করেছেন। অতীশ শুনেছেন, যে সব হিন্দুরা মানস সরোবরে তীর্থস্নান করতে যান, তাঁরা অনেকে একটু এগিয়ে ওই মহাবিহার দেখে মুগ্ধ হন, সেটিকে আদিবদরী নামে আখ্যায়িত করেন। কৈলাস পর্বত আর মানস সরোবর তো শুধু হিন্দুদের তীর্থ নয়, একদা শান্তরক্ষিত, কমলশীল থেকে পদ্মসম্ভব— অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিতই ও দেশে ধর্মপ্রচারে গিয়েছেন।
এই বয়সে অতীশের অবশ্য ধর্মপ্রচারে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তিব্বতে এখন বৌদ্ধ ধর্মের হাল খুব খারাপ। তন্ত্র, জাদু আর করুণাধর্মকে লোকে সেখানে গুলিয়ে ফেলেছে। সে দেশের শিক্ষিত এবং অভিজাতরাও মাঝে মাঝে বাড়িতে হুঙ্কার দেন, ‘আজ একটু ভাল মদ বানিয়ে রেখো, তন্ত্রে বসব।’ সাত-তাড়াতাড়ি মাংস-মুদ্রা ও মৈথুনের বামাচারে যে বোধিজ্ঞান অর্জন করা যায় না, ও দেশের ধর্মগুরুরা সেটি শেখান না। আর গুরুদের যদি প্রকৃত ধর্মদৃষ্টি না থাকে, দেশের বাকি মানুষ যে অনাচারের স্রোতে ভেসে যাবেন, বলা বাহুল্য।
ধার্মিক ইয়েশে-ও গত কয়েক বছর ধরে তাঁর রাজ্যকে এই সংস্কারাচ্ছন্ন বামাচারের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। গত কয়েক বছর ধরেই তাঁর প্রার্থনা, অতীশ যেন এ দেশে এক বার এসে তাঁদের ধর্মদীক্ষা দেন। দু’বার প্রচুর সোনাদানা, হিরে-জহরত দিয়ে বিক্রমশীলায় অতীশের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন, ভিক্ষু রাজি হননি।
দূতদের আসা সহজ। শুধু তিব্বত কেন, সুদূর চিন, খোটান থেকে বহু ছাত্র এ দেশে সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে আসে। সংস্কৃত শিখে স্বদেশের ভাষায় তারা সেই সব অনুবাদ করে, পুথিপত্র নিয়ে ফিরে যায়। তারাই মাঝে মাঝে শিক্ষকদের নিজের দেশ এবং রাজার বার্তা জানিয়ে দেয়। অতীতের ফা হিয়ান, হিউয়েন সাঙের সময় থেকে এমনই চলছে।
হিউয়েন সাঙ অবশ্য এ দেশে এসেছিলেন প্রায় পাঁচশো বছর আগে, কনৌজরাজ হর্ষবর্ধনের আমলে। এখন নালন্দা, উত্তরাপথ আর কনৌজের সেই রমরমা আর নেই। বাংলার পাল রাজাদের আনুকূল্যে, বিক্রমশীলা সেই শূন্যস্থান দখল করেছে। অতীশ নিজেও তো পূর্ববঙ্গের সোহোর নামে এক রাজ্যের রাজপুত্র। তাঁর বাবার নাম ছিল কল্যাণশ্রী, মায়ের নাম চন্দ্রপ্রভা। কিন্তু রাজবাড়ির মেজো ছেলে চন্দ্রগর্ভ যৌবনের শুরুতেই প্রব্রজ্যা নিয়েছিলেন। পরম কারুণিক বুদ্ধের নাম অনুসারেই তাঁর নাম রাখা হয় দীপঙ্কর। বুদ্ধ তো শুধু কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ বা শাক্যসিংহ নন, বহু নামে বহু বার এই ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সে রকমই এক পূর্বজন্মে তাঁর নাম ছিল দীপঙ্কর।
কালে কালে এই বাঙালি পণ্ডিতের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে। বণিকদের সঙ্গে সমুদ্র পেরিয়ে সুদূর সুবর্ণদ্বীপে চলে যান, সেখানে বিখ্যাত আচার্য ধর্মকীর্তির ছাত্র। দেশে ফিরে টানা পনেরো বছর নালন্দা, ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহারে অধ্যাপনা। জ্ঞানের কারণে আজকাল এই বঙ্গসন্তান দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ নামেই পরিচিত।
এ হেন দীপঙ্করকেই নাগসো শুনিয়েছিল রাজা ইয়েশে-ও’র শেষ বৃত্তান্ত। রাজার ধারণা ছিল, বাঙালি পণ্ডিতকে এ দেশে আনতে আরও বেশি ধনরত্ন দিতে হবে। আশেপাশের রাজ্যগুলিকে আক্রমণ করে সেখানকার কোষাগার লুঠ করতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু দুর্ধর্ষ তাতার দস্যুদের রাজ্যে তাঁর সব ছক উল্টে গেল। ধনরত্ন দূর অস্ত, উল্টে বন্দি হলেন সেখানকার রাজার হাতে। এ বার তাতার রাজের শর্ত, ইয়েশে-ও’কে এক শর্তেই ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। মুক্তিপণ হিসেবে তাঁর ওজনের সম-পরিমাণ সোনা দিতে হবে।
রাজার উত্তরাধিকারীরা সেই সোনা জোগাড়ও করেছিলেন। কিন্তু বন্দি রাজা তাঁদের অন্য কথা বলেন, ‘‘আমার বয়স হয়েছে, স্বাভাবিক নিয়মেই মৃত্যুর বেশি দিন বাকি নেই। এই সোনাদানা নিয়ে বরং বিক্রমশীলা মহাবিহারে চলে যাও, সেই পণ্ডিতকে আনার চেষ্টা করো।’’ সেই রাজপরিবারের আত্মীয়, মহাবিহারে আসা নতুন তিব্বতি ছাত্র নাগসো অতীশকে সেই কাহিনি জানিয়েছিল। এ দেশে তার নতুন সংস্কৃত নাম জয়শীল। উপাধ্যক্ষ নীরবে মর্মন্তুদ কাহিনিটি শুনেছিলেন।
কী করবেন তিনি এখন? এই ৫৯ বছর বয়সে হিমবন্ত পর্বত পেরিয়ে অচেনা দেশে যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন? কিন্তু গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং তো বারংবার মৈত্রী আর করুণা অবলম্বন করতে বলেছেন। মৈত্রীর দেশ, কাল ভেদ থাকে না। তা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য প্রযুক্ত। আর করুণা মানে তো শুধু রোজ প্রভাতে মহাবিহারের দ্বারে ভিক্ষুকদের ভিক্ষাদান নয়। তুমি আহত, তাই আমার কষ্ট হচ্ছে… এটিই বৌদ্ধ করুণা। অচেনা গুজে রাজ্যের মৃত রাজা ‘ইয়েশে ও’কে এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, তাঁকে শিরায় শিরায় অনুভব করতে পারছেন অতীশ।
জয়শীলকে সাবধানে থাকতে বললেন তিনি। তিব্বত থেকে এই বিহারে আসা বেশির ভাগ ছাত্রই জ্বরে ভুগে অনেক সময় মারা যায়। আর প্রতিশ্রুতি দিলেন, তিনি যাবেন। কিন্তু পুরো পরিকল্পনা যেন গোপন থাকে। মহাবিহারের অধ্যক্ষ, আচার্য রত্নাকর শান্তিকে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই।
আচার্য যথাসময়েই জেনেছিলেন সেই গোপন পরিকল্পনা। নাগসোকে বলা তাঁর উক্তি তিব্বতি পুথিতে আজও অম্লান, ‘‘আয়ুষ্মান, তুমি তো আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ রত্নটিকেই ও দেশে নিয়ে যাচ্ছ। ওঁকে সতর্ক ভাবে রক্ষা করো। আর তিন বছর বাদে এখানে পৌঁছে দিয়ে যেয়ো।’
অতঃপর শুরু হল ৫৯ বছর বয়সি শ্রমণের মহাযাত্রা! কে বলে, বাঙালি ভীরু এবং অ্যাডভেঞ্চারে পরাঙ্মুখ? ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে জয়শীল, বীর্যসিংহদের নিয়ে বিক্রমশীলা থেকে বেরিয়ে পড়লেন অতীশ। প্রথমে বজ্রাসন মহাবিহার, সেখানেই আছে বোধিবৃক্ষ। বৃক্ষতলে প্রণাম সেরে নেপালের পথে। স্বয়ম্ভূনাথের চৈত্যে প্রণাম সেরে এগোলেন তাঁরা।
তার পরই বিপর্যয়। নেপালের পাহাড়ি পথে, পালপা রাজ্যে জ্বরে আক্রান্ত হলেন বীর্যসিংহ। ঘোর জ্বর, প্রলাপ বকছেন। সঙ্গীদের সেবাতেও কিছু লাভ হল না। মধ্যরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
বীর্যসিংহের নশ্বর শরীর সেই রাতেই ভস্মীভূত করা হল নদীতীরে। পালপা রাজ্যে নিয়ম, কোনও অতিথি যদি কারও গৃহে এই জাতীয় জ্বরে বা অন্য কারণে মারা যান, রাজা তৎক্ষণাৎ সেই গৃহ বাজেয়াপ্ত করবেন। সকালবেলায় নদীর ধার থেকে বীর্যসিংহের পোশাক ও বিছানাপত্র ডোলিতে এমন ভাবে সাজিয়ে আনা হল, যেন অসুস্থ মানুষটি শয্যাশায়ী। মৃত্যুর আগে শিক্ষক অতীশের সঙ্গে তিব্বতি ভাষায় ‘দশ অকুশল কর্ম’-র একটি ব্যাখ্যা লিখছিলেন বীর্যসিংহ, তিব্বতি ত্রিপিটকে সেই ব্যাখ্যা আজও পরম যত্নে রক্ষিত।
প্রায় দুই বছরের পরিশ্রম-শেষে, কৈলাস পর্বত ও মানস সরোবর অতিক্রম করে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে অতীশরা পৌঁছলেন গুজে রাজ্যে। অতীশের সঙ্গে তাঁর আরাধ্যা তারা দেবীর ছোট্ট মূর্তি, সারা ক্ষণই বলেন ‘ওঁ তারে তুত্তুরে তারে।’ ওটিই তাঁর বীজমন্ত্র। আর বাংলার দুটি বিশেষণকে সেই পাল আমলেও অমর করে গেলেন অতীশ। তাঁর তিব্বতি শিষ্যরা সকলেই লিখেছেন, মানস সরোবর দেখে মুগ্ধ অতীশ মাঝে মাঝেই বলছিলেন, ‘ভালা। অতি ভালা।’
ইতিহাস জানে, এই বাঙালি পণ্ডিত স্বদেশে আর প্রত্যাবর্তন করতে পারেননি। গুজে রাজ্য থেকে বেরিয়ে, তিন বছর পর নাগসো তাঁকে নেপাল সীমান্তে নিয়ে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেখানে তখন পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ। প্রতিশ্রুতি দিয়েও রত্নাকর শান্তির বিক্রমশীলা মহাবিহারের শ্রেষ্ঠ রত্নটিকে ফিরিয়ে দিতে পারলেন না জয়শীল। পশ্চিম তিব্বতের গুজে রাজ্যেও আর ফিরলেন না অতীশ, তাঁর তিব্বতি শিষ্য দোম তোনপা তাঁকে নিয়ে গেলেন মধ্য তিব্বতের লাসা শহরে। ১৩ বছর সেখানে কাটিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন অতীশ।
হাজার বছর পরে এই বাঙালির ঐতিহ্য কোথায়? পাণ্ডিত্য এবং প্রৌঢ়ত্বে তিব্বত অভিযান ছাড়া আর কোথাও কি আছে তাঁর অভিজ্ঞান? উত্তর একটাই। ধর্মসংস্কার! বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা ঘুচিয়ে রামমোহন, বিদ্যাসাগর বা স্বামী বিবেকানন্দ এ দেশে যে ভাবে হিন্দু ধর্মকে বাঁচিয়েছিলেন, তিব্বতে অতীশ সেটিই করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম মানে রাজারাজড়া ও অভিজাতদের মদ্যপ তান্ত্রিকতা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও মৈত্রী ও করুণা সঞ্চার। মদ, মাংস নয়। ফুল, দীপদান, শিঙা, ঢাক ও কাঁসর, ঘণ্টাধ্বনিতে বুদ্ধের পুজো। থোলিং মহাবিহারে এ নিয়ে ‘বোধিপথপ্রদীপ’ নামে এক গ্রন্থ লিখেছিলেন অতীশ, আজও তার বিষয়বস্তু নিয়ে সারা বিশ্বে বক্তৃতা দেন চতুর্দশ দলাই লামা। ‘‘সবচেয়ে বড় ক্ষমতা নিজেকে অহং থেকে মুক্ত করা। পৃথিবীতে কিছুই শাশ্বত নয়, তাই আসক্তি ত্যাগ আসল কথা। আর সেই অনাসক্তি থেকেই সর্বজীবের প্রতি উদ্ভূত হবে মৈত্রী ও করুণা’’— হাজার বছর আগে শিখিয়ে গিয়েছিলেন এই বাঙালি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy