Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

পূজাবার্ষিকীর আনন্দকথা

অকালবোধনের সঙ্গে সঙ্গে শারদ সাহিত্য কেমন করে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল এও এক বড় জিজ্ঞাসা। এর কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথেরই।

যতই পড়াশোনার চাপ থাকুক না কেন তবুও পুজোসংখ্যা সিলেবাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুজোর ছুটির সিলেবাস।

যতই পড়াশোনার চাপ থাকুক না কেন তবুও পুজোসংখ্যা সিলেবাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুজোর ছুটির সিলেবাস।

রাজলক্ষ্মী বসু
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পুজোসংখ্যা। বাঙালির একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা। বাঙালির শারদীয়া ছুটি তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন হকারের হাত থেকে শারদ সংখ্যা হাতে আসে। হাত নিশপিশ করে পুজো সংখ্যার পৃষ্ঠাগুলো ওলোট-পালট করতে। যতই পড়াশোনার চাপ থাকুক না কেন তবুও পুজোসংখ্যা সিলেবাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুজোর ছুটির সিলেবাস। বাঙালি ছাড়া বোধ হয় আর কোনও জাতিই ‘পুজোসংখ্যা’ তথা উৎসবের পত্রিকার মতো বিষয় নিয়ে এত তৎপরতা, উৎসাহ, গবেষণা করে না। ছোট থেকে বড় সবার কাছেই অবেদনময়ী রংচঙে মোড়কের এই বই।

অকালবোধনের সঙ্গে সঙ্গে শারদ সাহিত্য কেমন করে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল এও এক বড় জিজ্ঞাসা। এর কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথেরই। বাঙালির জন্য এত ভাবনা কে-ই বা আগে ভেবেছেন। সারা পুজোর ছুটি সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালি শুধুই কি অবসরে কাটাবে? তাই রসঙ্গ পাঠকের কাছে ১২৯৮ অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম প্রকাশিত ‘সাধনা’ পত্রিকা তুলে দেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালি প্রথম বার শারদ তৃপ্তির রসদ পায়। পরের বছরই, অর্থাৎ ১২৯৯ সালে সাধনা পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন যুগ্ম সংখ্যা শারদ সংখ্যা হিসেবেই প্রচারিত হয়েছিল। সে সংখ্যা বোধ হয় সেরা শারদ সংখ্যার একটি। কারণ, সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শারদ গল্পের লেখক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

‘‘আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে… মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্লব নব শীতবায়ুতে শিরশির করিয়া উঠিতেছে।’’ এমন যদি শারদ সংখ্যার লেখনী হয়, তা তো শারদীয়া সংখ্যা সৃষ্টির, প্রকাশের, সম্পাদনার ইন্ধন জোগাবেই। সব সম্পাদকই রবীন্দ্রনাথের এক খণ্ড লেখা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। কত যে সনির্বন্ধ অনুরোধ নিয়ে চিঠি আসত তাঁর কাছে, তা তিনিই জানেন। ১৩২৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পার্বতী’ পত্রিকার শারদীয়া বার্ষিকী সম্পাদনা করেন। এখানেই সম্ভবত প্রথম পুজোর গান রবীন্দ্রনাথ জমা দেন। গানটি ছিল ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে…’।

আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ রবীন্দ্রনাথের কলম স্পর্শে ধন্য। ১৯৩৫ সালে পুজোসংখ্যায় লেখার জন্য আনন্দবাজার রবীন্দ্রনাথকে ১০০ টাকা বায়না দেয়। রবীন্দ্রনাথ এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে শান্তিনিকেতন থেকে চিঠি লিখে জানান, ‘‘এখনকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগত ভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দু’টি কবিতার জন্যে একশো টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেইজন্যে ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখার প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।’’ দুটি বিখ্যাত গল্প ‘রবিবার’ এবং ‘ল্যাবরেটরি’ও প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকার পুজোসংখ্যা ১৯৩৯ আর ১৯৪০ সালে।

অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী কিকিরা, প্রফেসর শঙ্কু, গোগল, কর্নেল আর ম্যাজিশিয়ান-এর সঙ্গে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-তেই পরিচিত হয়েছে। কথা উঠছে মানুষের পড়ার প্রবণতা কমছে। শারদ সাহিত্য বোধ হয় সে তথ্য ভুল প্রমাণ করে। সেকাল থেকে একাল দিনকে দিন শারদ সংখ্যা বাড়বাড়ন্ত। অগুন্তি বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রিকায়, ব্লকজিন, এমনকি ই-ম্যাগাজিনেও নতুন নতুন কলম পূজাবার্ষিকীকে সমৃদ্ধ করছে।

কত যে বাঙালি তৃপ্তি এই পুজো সংখ্যায় তার হিসেব নেওয়াই মূর্খামি। লেখা ঘিরে সম্পাদক, লেখক, পাঠক সবারই স্নায়ুতে দড়ি টানাটানি। যাঁরা সারা বছর বই কেনেন না, তারাও বোধ হয় শারদ সংখ্যার মোহময়ী জাদুতে একটা না একটা ম্যাগাজিন তো নিয়েই নেন। আর যারা চর্চা করেন তারা তো সংখ্যা হাতে নিয়েই নাম না দেখেই বলতে পারবেন কোনটা বিমল দাসের আর কোনটা সমীর সরকারের আঁকা। ‘সন্দেশ’ পুজোবার্ষিকী সত্যজিৎ স্রষ্টা এক অসামান্য উপহার, কেবলমাত্র বাঙালিকেই। চণ্ডী লাহিড়ী, রেবতীভূষণ, দেবাশীষ দেবের কার্টুনও ছিল পুজো সংখ্যার নতুন মাত্রাযোজক।

আশ্বিনের রূপকথায় শারদ সাহিত্য বহু নতুন নতুন কলমের জন্ম দিয়েছে। বিকাশ হয়েছে নতুন সাহিত্যিকের শরতের সোনা রোদ আর শিউলি আঘ্রাণ মাখতে মাখতে শারদ সংখ্যা পড়ার অভিজ্ঞতা কার না নেই।

পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়ার আনন্দযজ্ঞ কেবলমাত্র শারদ সংখ্যাতেই পাওয়া যায়। পুজো সংখ্যা ছুঁয়ে দেখার খুশি নিজের ভাষা এবং বর্ণমালাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শেখায়, প্রতি বছর আমাদের সাগ্রহে অপেক্ষা থাক নতুন পুজো সংখ্যার জন্য। ছুটির আকাশটুকু আরও ঝলমলে হয়ে উঠুক।

অন্য বিষয়গুলি:

Literature Durga Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy