Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
মাতৃভূমি রক্ষার অধিকার
Soviet Union

আগ্রাসনকারীর আক্রমণ রুখতে যে যার জায়গা থেকে প্রতিরোধ

রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা হতেই পারে কিন্তু মাতৃভূমিকে ভালবাসার মৌলিক অধিকার রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।

ইতিহাস হয়তো এ ভাবেই ফিরে আসে।

ইতিহাস হয়তো এ ভাবেই ফিরে আসে।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের ব্রেস্ট দুর্গকে হিটলারের সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে যাঁরা রক্ষা করেছিলেন তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন তিমেরান জিনাতভ। ২২ জুন ১৯৪১। সেই সময় ব্রেস্ট দুর্গের দেওয়াল চেঁছে একটি পঙক্তি লেখা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর সেই পঙক্তিটিকে, সোভিয়েট জনতার সাহস এবং পার্টির প্রতি তাঁদের ভক্তির নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে সেন্ট্রাল কমিটি কিন্তু পঙক্তিটির জনক ঠাওরানো হয় কোনও অনামা সৈনিককে যখন কি না ব্রেস্ট দুর্গ রক্ষা করার যুদ্ধ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারা সৈনিকরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে, ওই পঙক্তির রচয়িতা তিমেরান জিনাতভ, মাতৃভূমিকে বাঁচাবার যুদ্ধে নামলেও যিনি সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। সাংবাদিকতায় সাহিত্যের নোবেলজয়ী স্বেতলানা আলেক্সিভিচ তাঁর ‘সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইম’এ এক মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন, যুদ্ধে জেতার বহু দিন পর রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে জিনাতভের আত্মহত্যার। সুইসাইড নোটে তিনি লিখেছিলেন, “প্লিজ় আমাকে পাগল ভাববেন না।’’ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না জিনাতভ, পার্টি তাঁকে বঞ্চিত করেছিল প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে, তবু তিনিই নিজের দেশকে টুকরো টুকরো হতে দেখে আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন, কারণ যুদ্ধটা তিনি হিটলারের বিরুদ্ধে বা স্তালিনের পক্ষে করছিলেন না। লড়াইটা লড়ছিলেন মাতৃভূমির জন্য। পঙক্তিটি ছিল: ‘‘আই ডাই, বাট আই ডু নট সারেন্ডার! সো লং মাই মাদারল্যান্ড!’’

জিনাতভের কথায় পড়ে মনে পড়েছে বিপ্লবী গণেশ ঘোষের কথা। শুনেছি, দেশভাগের পর চট্টগ্রাম থেকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়ে তিনি যত কষ্ট পেয়েছিলেন, তার বেশি আঘাত পেয়েছিলেন ১৯৬২ সালের ২১ নভেম্বর চিন-ভারত যুদ্ধের সময় জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তদের সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে। ২২ তারিখ আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘‘সারা দেশে দেশদ্রোহীদের ধরপাকড়।’’ সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হচ্ছে এই হেডলাইন। একটা সত্য সামনে চলে আসছে যে ‘দেশদ্রোহী’ শব্দটা ইদানীং আবিষ্কৃত হয়নি।

আচ্ছা, একটি যাত্রা দলের সদস্যও কি সেই দলকে প্রকাশ্যে নস্যাৎ করতে পারেন? তা হলে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে স্বাধীনতাকেই মিথ্যে বলার অধিকার আসে কোথা থেকে? বাষট্টি সালের ১৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দেওয়া বক্তৃতায় জ্যোতি বসু, দেশের প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত রক্ষার পক্ষে দাঁড়ানোর কথা বলতে গিয়ে নিজের একটি পুরনো মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত এবং চিনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিতর কোনও মধ্যস্থতাকারী থাকুক।

মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জ্যোতিবাবু যে দেশকেই চেয়ে থাকুন, তাঁর এই কথার জন্য কেবল লালবাহাদুর শাস্ত্রীই তাঁকে সেন্সর করেননি, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদও মেনে নেয়নি ওই প্রস্তাব। তখন তিনি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বলেন যে ওই বিবৃতি তাঁর ‘ব্যক্তিগত মত’ ছিল। প্রশ্ন হল যে ওই ‘ব্যক্তিগত মত’ মানেননি কারা? শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, ভূপেশ গুপ্ত, সোমনাথ লাহিড়ীরা— আর ক’দিন পরেই যাঁদের ‘সংশোধনবাদী’ বলে চিহ্নিত করা হবে। জ্যোতি বসুর ‘…নির্বাচিত ঐতিহাসিক ভাষণ’-এর টীকায় লেখা আছে, “রাজনৈতিক প্রশ্নে সিপিআই’র অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যও সীমান্ত-সংঘর্ষের ঘটনার সময় প্রকট হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সংশোধনবাদীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। আর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদে গরিষ্ঠতা ছিল বামপন্থী অংশের। সীমান্ত-সংঘর্ষের সময় কেন্দ্রীয় পরিষদের সিদ্ধান্তের সাথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাই একমত ছিলেন না।”

আরও পড়ুন: জরুরি অবস্থা কেন, গণতন্ত্র দিয়েই আজ গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করা যায়

প্রশ্ন জাগে, আগ্রাসনকারী চিন আর আক্রান্ত ভারতের মধ্যে তৃতীয় শক্তিকে ঢোকাতে চেয়ে, তাকে ‘মধ্যস্থতাকারী’ আখ্যা দিয়ে ‘আক্রমণ’টাকে ‘ঝামেলা’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা কেন? যখন কোণঠাসা তখন, ‘ব্যক্তিগত মত’ আর পরিস্থিতি পাল্টালেই ভিন্নমত সঙ্গীদের ‘সংশোধনবাদী’ আখ্যা দিয়ে ক্ষমতার বিন্যাস পালটে দেওয়াই বা কিসের জন্য? এই ভাবেই “পতাকার লালে আমারও একবিন্দু রক্ত মিশে আছে” উচ্চারণ করা কবি ও দার্শনিক নিকোলাই বুখারিনকে “ভাড়াটে খুনি ও ফ্যাসিবাদের দালাল” আখ্যা দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, ও দিকে কলকাতার বুকে “আগে ছিলেন বিপ্লবী আর আজকে দালাল চিনের/ বদলে যাওয়া গণেশ ঘোষের চেহারা নিন চিনে” জাতীয় স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গণেশ ঘোষ ভোটে হেরে যান আর ‘ব্যক্তিগত মত’-এর প্রবক্তারা মসনদে বসেই আগের পর্বগুলো ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন। ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’এর বিস্ফোরণে ইঞ্জিন থেকে আলাদা হয়ে যায় অনেকগুলো বগি।

আরও পড়ুন: স্বপ্ন দেখব বলে কাজও করব

ইতিহাস হয়তো এ ভাবেই ফিরে আসে। এক দিন যাঁরা অন্যদের সংশোধনবাদী হিসেবে টার্গেট করতেন, তাঁরা দেখতে পান যে তাঁদের গায়েই সেই তকমা এসে লেগেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই সদম্ভ দ্বিচারিতা যেখানে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা কিউবার কমরেড দেশপ্রেমিক, কিন্তু রাশিয়ার ট্যাঙ্কের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো চেকোস্লোভাকিয়ার মানুষটি প্রতিক্রিয়াশীল। কারণ তত দিনে সারা পৃথিবী হিটলার-মুসোলিনির পাশাপাশি স্তালিন এবং মাওয়ের অকল্পনীয় নৃশংসতারও হিসেব করা শুরু করে দিয়েছে।

এখনও করছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্বিচারে লক্ষ-লক্ষ মানুষকে খুন করা পাকিস্তানের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছিল, তাদের পক্ষেও এখন চিন থেকে পাওয়া অস্ত্রে নাশকতা চালিয়ে সমাজবদলের স্বপ্ন ফেরি করা সম্ভব নয়। ছত্তীসগঢ় কিংবা মহারাষ্ট্রে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সৈন্যদের খুন করে এবং মৃত সৈনিকদের শরীরকে লাঞ্ছিত করে তোলা ভিডিয়ো দেখিয়ে নিজেদের সমাজবিচ্ছিন্ন করাই সহজ বরং।

সেই সব ভিডিয়ো সমর্থন করা দু-একজন আবার বিধ্বংসী ঝড়ের পর রাস্তায় গাছ পড়ে থাকলেও সেনাবাহিনী কেন জলদি এসে তা সরাচ্ছে না তাই নিয়ে ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। যদি না সরায়? যদি প্রশ্ন করে যে যাদের মৃত্যুতে উল্লাস করেন তারা কেন আপনার ঘুম নির্বিঘ্ন করার জন্য শূন্য ডিগ্রির নীচে দাঁড়িয়ে থাকবে সিয়াচেন বা গালওয়ানে?

প্রশ্নটা যাতে না ওঠে তার জন্য নিজের আগে দেশকে রাখা জরুরি। পেসমেকারের ব্যাটারি কিংবা অত্যাবশ্যক আরও অনেক পণ্য যতটা আমদানি করা জরুরি ততটা করাই উচিত। চিনা খেলনাপাতি কিংবা ধাতুর মূর্তির উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানো দরকার যাতে ভারতে তৈরি জিনিস প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা বিভিন্ন রাজ্যের সরকার যদি মনে করেন যে একটি কাজের বরাত চিনের কোনও সংস্থাকে দিলে খরচ কয়েকশো কোটি কমবে তা হলে সে ক্ষেত্রেও দেশীয় শ্রমিক নিয়োগ করা যেতে পারে। ভরসার ব্যাপার হল, সাধারণ মানুষ যখন মুকুন্দ দাসের গান শুনে বিলিতি কাপড় আগুনে ফেলে দিতেন, তখন কোথাকার কোন নেতার ছেলে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ছে তাই নিয়ে ভাবতেন না। আজকেও যে যার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না কেন? মোবাইল ফেলে দিতে না পারলেও দেওয়াল থেকে মাওয়ের ছবি নামিয়ে রাখতে অসুবিধে কোথায়?

প্রশ্নটা সরল। ক্ষমতার বৃত্তে থাকাকালীন যিনি আমার দেশ আক্রমণ করেছিলেন আমি কি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছি? রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা হতেই পারে কিন্তু মাতৃভূমিকে ভালবাসার মৌলিক অধিকার রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ওটা সেই স্পন্দন, যা জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি নাড়িতে পাওয়া যায়; সেই নাভি, মরবার পরেও যাকে পোড়াতে পারে না কোনও চুল্লি।

বাষট্টি সালে যুদ্ধ লাগার পর, নেতার নাম কৃষ্ণপদ ঘোষ না কি মুজফফর আহমেদ, তা বিচার করা হয়নি, পাইকারি দরে আটক করা হয়েছিল। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কংগ্রেস বলেছিল, ‘নোংরা মাছি’, ফরওয়ার্ড ব্লক বলেছিল, ‘পঞ্চম বাহিনী’। আজ কিন্তু সীতারাম ইয়েচুরি এবং ডি রাজা প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় বৈঠকে বক্তব্য রাখছেন, কোনও নেতা গ্রেফতার হননি। এটা ভারত সরকারের সংবেদনশীলতা হিসেবে দেখার দরকার নেই, ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিপক্বতা হিসেবে দেখুন। আর ভারতীয় গণতন্ত্র যদি এতটা এগিয়ে আসতে পারে, ভারতের পার্টি ভারতীয় পার্টি হওয়ার জন্য খানিকটা এগোতে পারবে না কেন? কেন আজ চিনকে সীমান্তে গা-জোয়ারি করা থেকে বিরত রাখার ট্র্যাক-টু ডিপ্লোম্যাসি করা যাবে না? সফল হলে তো সরকারের উপর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ব্যয় বাড়ানোর দাবি তোলাই যাবে!

‘ইন্টারন্যাশনাল’ গাইলে পরে ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া নিষেধ কে বলল?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy