রাহুলজি তো দারুণ কাজ করছেন! ম্যাডামকে বললাম।’’ শুনে সনিয়া গাঁধী কী বললেন? ‘‘হাসলেন। মাথা নেড়ে সায় দিলেন।’’ সময়টা ২০০৮-এর শেষ দিক। বছর খানেক আগে রাহুল গাঁধী এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক পদে এসেছেন। যুব কংগ্রেস ও ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব পেয়ে সংগঠনে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মুখ তুলে আনতে চাইছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই দিল্লিতে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করলে নিয়ম করে রাহুলের প্রশংসা করতেন।
শুধু বাংলা নয়। অন্য রাজ্যের অনেক কংগ্রেস নেতাও দশ জনপথের ‘ম্যাডাম’-এর সঙ্গে দেখা করলে এই মন্ত্র মেনে চলতেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ম্যাডামের মন জয়ের এটাই ব্রহ্মাস্ত্র। রাহুলের সহ-সভাপতি হতে বছর পাঁচেক দেরি। কংগ্রেস হাইকমান্ড মানে শুধুই সনিয়া গাঁধী। হাইকমান্ডই ঠিক করে, কাকে লোকসভা ভোটে প্রার্থী করা হবে, কে রাজ্যসভায় আসবেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কে হবেন, কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় এলে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন। অতএব, হাইকমান্ডকে খুশি রাখতে হবে। প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখাতে হবে। তাঁর সহজ উপায় একটাই। মায়ের কাছে ছেলের প্রশংসা।
কংগ্রেসের এই নেতারা তখনও জানতেন না, ২০১৩-য় কংগ্রেসের সহ-সভাপতির পদে বসে রাহুল গাঁধী প্রথমেই দলের এই জো-হুজুরির সংস্কৃতিটাই ভাঙার চেষ্টা করবেন। ২০১৪-য় লোকসভা ভোটে রাহুল নিদান দিলেন, আমেরিকার ‘প্রাইমারি’-র কায়দায় কংগ্রেস প্রার্থী ঠিক হবে। কংগ্রেস কর্মীদের ভোটে ঠিক হবে, টিকিট-প্রত্যাশীদের মধ্যে দল কাকে প্রার্থী করবে। হাইকমান্ড কাউকে চাপিয়ে দেবে না।
বেশ কিছু লোকসভা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ভাবে ‘প্রাইমারি’ হল। দেখা গেল, কংগ্রেসের অন্দরে যার যেখানে প্রভাব বেশি, তিনিই ‘প্রাইমারি’-তে জিতছেন। যেমন, উত্তর কলকাতায় সোমেন মিত্র ছাড়া আর কোনও কংগ্রেসের টিকিট-প্রত্যাশী মিলল না। কোথাও দেখা গেল, গাঁধী-পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতদের বিরুদ্ধে কেউ লড়তে নারাজ।
ভুল করেছিলেন রাহুল। তাঁর হয়তো ধারণা ছিল, কংগ্রেস এখনও সেই আদ্যিকালের গণতান্ত্রিক দল, যার নিচুতলায় নিবেদিত-প্রাণ ক্যাডার বাহিনী, রাজ্যে রাজ্যে শক্তিশালী নেতৃত্ব! থাকলে হয়তো তাঁর ‘প্রাইমারি’-র পরীক্ষানিরীক্ষা সফল হত। হয়নি। পুরনো সেই কংগ্রেস রাহুলের ঠাকুমা ইন্দিরা গাঁধীর আমলেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সনিয়া ভারতে আসেন ১৯৬৮-তে। পরের বছরই ইন্দিরা কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল গড়েন। ইন্দিরার কংগ্রেসই আসল কংগ্রেস হয়ে ওঠে। ইন্দিরা চেয়েছিলেন এমন একটা কংগ্রেস, যে কংগ্রেস তাঁকে ছাড়া চলতে পারবে না। নিজের অনুগত নেতাদের প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে বসাতেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ দিয়ে আনুগত্য কিনতেন। কার ডাকে কত মানুষ রাস্তায় নামে, তা বিচার করেননি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪— সনিয়া দেখেছেন, কংগ্রেস মানে তাঁর শাশুড়িমায়ের ইচ্ছেয় ওঠাবসা করা একটি দল। রাজীবের আমলের সাত বছরেও এই ধারা বদলায়নি। এখন যে কংগ্রেস গাঁধী পরিবারকে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে পারে না, তার মূলে ইন্দিরা।
এই ‘মডেল’ যে চলবে না, ইন্দিরা জমানাতেই বোঝা যাচ্ছিল। রাজীব গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯৮৯-এ হেরে যাওয়ার পরে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তার পরে আর কংগ্রেস একার ক্ষমতায় কেন্দ্রে সরকার গড়তে পারেনি। ২০০৪, ২০০৯-এ কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে ঠিকই। কিন্তু তার পিছনে গাঁধী পরিবারের ক্যারিশ্মা ছিল না। পারিবারিক গড় অমেঠী-রায়বরেলীতেও যে এখন আর গাঁধী পরিবারের ‘ম্যাজিক’ কাজ করে না। ১৯৯৮ থেকে ২০১৭— কংগ্রেস সভানেত্রী হিসেবে সনিয়ার ১৯ বছরে লোকসভায় কংগ্রেসের আসন ১১৪ থেকে ৪৪-এ নেমে এসেছে। পরিবার-কেন্দ্রিক দল থেকে কংগ্রেস আর গণতান্ত্রিক সংগঠন হয়ে উঠতে পারেনি। সনিয়ার আমলে কংগ্রেসে নতুন নেতৃত্বও তৈরি হয়নি। প্রবীণরা প্রায় সকলেই রাজীবের জমানার। নতুনদের সিংহভাগই কংগ্রেসের নেতাদের পুত্র-কন্যা। বরঞ্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে জগনমোহন রেড্ডিরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের দল গড়ে সাফল্য পেয়েছেন।
রাহুল এই ‘সিস্টেম’ ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। নতুন করে দল গড়তে তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল, কংগ্রেসের সংগঠনে গণতন্ত্র ফেরানো। নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্বে নতুন মুখ তুলে আনা। কিন্তু সেটা অতিসরলীকরণ হয়ে গিয়ে দাঁড়াল, নবীন বনাম প্রবীণের লড়াই। নবীন-প্রবীণ দুই শিবিরই ভাবল, রাহুল প্রবীণদের সকলকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সর্বস্তরে তরুণ নেতাদের হাতে ক্ষমতা দিতে চাইছেন। রাহুল বোধ হয় নিজেও এই অতিসরলীকরণের ফাঁদে আটকে পড়লেন।
এখন রাজস্থানে সচিন পাইলট প্রবীণ অশোক গহলৌতকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইছেন। মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কমল নাথকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসতে চেয়েছিলেন। তার পিছনেও নবীন বনাম প্রবীণের লড়াইয়ের ‘মিথ’। তরুণ তুর্কিরা গদি দখল করতে চাইছেন। প্রবীণরা আতঙ্কিত হয়ে তরুণদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। নতুন নেতৃত্ব তৈরির বদলে নিজের ছেলেমেয়েদের গদিতে বসাতে চাইছেন। রাহুলের প্রিয়পাত্ররাই বেশি কোণঠাসা হয়েছেন। সিন্ধিয়া, সচিন থেকে অশোক তানওয়ার— অজস্র উদাহরণ।
ঘুঘুর বাসা সহজে ভাঙা কঠিন বুঝে রাহুল প্রবীণ-নবীনের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফেরার পরে রাহুল কমল নাথ-সিন্ধিয়া, গহলৌত-সচিনকে এক মেরুতে আনতে চেয়েছিলেন। অসমে তরুণ গগৈকে সরিয়ে হিমন্তবিশ্ব শর্মা রাজ্যের নেতৃত্ব চাইলে তিনি সাড়া দেননি। হিমন্তবিশ্ব বলেছিলেন, তাঁর কথা না শুনে রাহুল পোষা কুকুর পিডি-কে বিস্কুট খাওয়াতে ব্যস্ত ছিলেন। কংগ্রেস ছেড়ে হিমন্তবিশ্ব এখন উত্তর-পূর্বে বিজেপির এখন তুরুপের তাস। সিন্ধিয়া-সচিন যদি অধৈর্য হয়ে বিজেপির দিকে পা বাড়ালে রাহুলের দিকেই প্রশ্ন ছোড়া উচিত, দলে এই মাৎস্যন্যায়ের জন্য তিনিই কি দায়ী নন?
রাজস্থানে প্রবীণ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তরুণ সচিন পাইলটের বিদ্রোহে কংগ্রেসে নতুন করে ভাঙনের আশঙ্কা তৈরির পর দেখা যাচ্ছে, বিজেপির অনেক নেতাও কংগ্রেসের এই দুরবস্থার জন্য গাঁধী পরিবারকে দায়ী করছেন। মোদী কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের কথা বললেও বিজেপির অনেক নেতাই জাতীয় স্তরে একটি বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা বোঝেন। নয়-নয় করেও কংগ্রেস এখনও ন’-দশটি রাজ্যে শক্তিশালী। আর কোনও আঞ্চলিক দলের পক্ষে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের জায়গা নেওয়া মুশকিল। কিন্তু কংগ্রেসের ভাঙন রুখবে কে?
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে দলের ভরাডুবির দায় নিয়ে রাহুল সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। এক বছর পরে ফের দাবি উঠেছে, রাহুল সভাপতির পদে ফিরুন। খাতায়-কলমে রাহুল এখন স্রেফ কংগ্রেসের সাংসদ, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। কিন্তু বাস্তবে তিনিই পিছন থেকে দল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। বিহারের ভোট নিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। অতিমারি, অর্থনীতি, বিদেশনীতির প্রশ্নে মোদী সরকারের বিরোধিতার সুর রাহুলই বেঁধে দিচ্ছেন। তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন সফল করতে কংগ্রেসের গোটা মিডিয়া টিম ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাহুল তাতে আপত্তি তোলেন, এমন খবর নেই।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নীললোহিতের মতো হঠাৎ হঠাৎ দিকশূন্যপুরে চলে যাওয়া রাহুল কি তা হলে দায়িত্বহীন ক্ষমতা উপভোগ করতেই ভালবাসেন? পঞ্চাশে পা দেওয়া রাহুল কংগ্রেসের সভাপতি পদে ফিরতে চাইতেই পারেন। তাতে সংগঠনে গণতন্ত্র ফিরবে না। ২০১৭-র ডিসেম্বরে রাহুল যখন দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হননি। এখন শশী তারুর-সন্দীপ দীক্ষিতরা সভাপতি পদে নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু নির্বাচনে রাহুল প্রার্থী হলে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কি খাড়া হবেন!
যতই নবীন-প্রবীণের লড়াই থাকুক, কংগ্রেস চায়, রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেসের সাফল্য আসুক। কিন্তু রাহুল সংগঠন ঢেলে সাজাতে গেলেই বাধা আসবে। এটাই রাহুলের সামনে সবচেয়ে বড় ধাঁধা। তাঁকে সম্প্রতি প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি সভাপতি পদে ফিরতে তৈরি? রাহুলের উত্তর: এক বছর আগে আমার পদত্যাগের চিঠি পড়ে দেখুন। তাতে রাহুল লিখেছিলেন, পার্টি পুনর্গঠনের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ভোটে ব্যর্থতার জন্য অনেককে দায়ী করতে হত। তা না করে তিনি নিজেই দায় নিচ্ছেন।
উপায় নেই। নেহরু-গাঁধী পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মকে কংগ্রেসের ভরাডুবির দায় নিতেই হবে। উদ্ধার করার চেষ্টাও তঁাকেই করতে হবে, সে চেষ্টা সফল হোক বা না হোক।
রাহুল গাঁধীর আসল লড়াই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সঙ্গে নয়। ইন্দিরা-রাজীব-সনিয়ার জমানায় বহমান কংগ্রেসি সংস্কৃতির সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy