মৃতের মুখ দেখা যাচ্ছে? না। কোনও ক্ষত, বা রক্ত? না, তা-ও নেই। শিশুটি চেনা যাচ্ছে নাকি? না, কোনও ভাবেই নয়। তা হলে এই ছবি ছাপতে অসুবিধে হওয়ার তো কথা নয়। এ রকমই কি কোনও সংলাপে সে দিন সরগরম হয়েছিল মেক্সিকোর সংবাদপত্র ‘লা হোর্নাদা’র নিউজ়রুম? ছবিটি ছাপার জন্য কি এ ভাবেই সওয়াল করতে হয়েছিল সাংবাদিক হুলিয়া ল্য দুক-কে? এল সালভাডর থেকে আসা শরণার্থী, ২৪ বছর বয়সি অস্কার আলবার্তো মার্তিনেজ় রামিরেজ় এবং তাঁর ২৩ মাসের শিশুকন্যা অ্যাঞ্জি ভালেরিয়া এম-এর মৃতদেহের ছবি ‘লা হোর্নাদা’য় প্রকাশিত, একটি মার্কিন দৈনিকে পুনঃপ্রকাশিত এবং ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরে আগে বহু বার করা প্রশ্নগুলি ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাডর। এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে ছোট্ট কিন্তু সবচেয়ে জনবহুল দেশ। মেক্সিকো পেরিয়ে আমেরিকা ঢোকার জন্য মধ্য আমেরিকা থেকে যে হাজার হাজার শরণার্থী ঘরবাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে ছিল এল সালভাডরের রামিরেজ় পরিবারও। লক্ষ্য, উত্তর মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে কোনও ভাবে আমেরিকায় ঢুকে পড়া। মাঝখানে শুধু রিয়ো গ্র্যান্ডে নদী! মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দমনমূলক শরণার্থী নীতির মূর্তিমান রূপক যেন এই নদী— খরস্রোতা, এখানে-ওখানে চোরাবালি, কুমিরে থিকথিক। এই নদী পেরোতে গিয়েই ভবনদী পার হয়ে যান কত শত শরণার্থী! সেই নদীর পাড়েই পড়ে ছিল বাবা-মেয়ের মৃতদেহ। নিজের কালো টি-শার্টের মধ্যে একরত্তি ভালেরিয়াকে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন রামিরেজ়। শেষরক্ষা হয়নি। হুলিয়ার তোলা ছবিটি ২৫ জুন ছাপা হয় ‘লা হোর্নাদা’য়।
মধ্য আমেরিকার শরণার্থী সমস্যা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আলোচনা কম হয়নি। সেই শরণার্থী সমস্যারই ভয়াবহ দিকটা যেন ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল হুলিয়ার তোলা ছবিটি। যেমন চার বছর আগে পশ্চিম এশিয়ার শরণার্থী সমস্যাকে সারা বিশ্বের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিয়ে এসেছিল বছর তিনেকের আলান কুর্দির মৃতদেহ।
বিতর্ক তখনও কম হয়নি। কিন্তু এ কথা আজ মানতে বাধা নেই যে, তুরস্কের সাংবাদিক নিলুফার ডেমারের তোলা নীল হাফপ্যান্ট আর লাল জামা পরা সিরীয় খুদের ওই ছবিই বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর শরণার্থী নীতিকে। ২০১৫-র ৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপের অধিকাংশ প্রথম সারির দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা আলানের দেহের ছবি। শিরোনামে জরুরি প্রশ্ন, ‘ইউরোপ, এর পরেও কি তুমি উদ্বাস্তুদের হাহাকার শুনতে পাবে না?’ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছবি হুহু করে ছড়িয়ে পড়ার পরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবীতে। সকলের মুখে একটাই কথা— আইএস-তাণ্ডবে পশ্চিম এশিয়ায় তৈরি উদ্বাস্তু সমস্যার শেষ কোথায়? নিরীহ শিশুর অপমৃত্যুর এই ছবি দেখার পরেও কি শরণার্থীদের প্রতি ইউরোপের মনোভাব বদলাবে না? পরে জানা যায়, ছবিটি দেখে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ফোন করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এর্দোয়ান-সহ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাকে। বলেছিলেন, ‘‘শরণার্থীদের প্রতি সারা বিশ্বের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছে, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই ছবি।’’ ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন-ও বলেছিলেন, ‘‘মানবসভ্যতা যে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তা বলে দিচ্ছে মৃত শিশুর এই ছবি।’’ বিভিন্ন দিক থেকে প্রবল চাপের মুখে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সেই বছরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেড় লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে তারা।
শিশুর মৃতদেহ ছাপা না-ছাপার বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম মার্কিন চিত্রবিশেষজ্ঞ রোন্ডা রোল্যান্ড শিয়ারারকে। নিউ ইয়র্ক থেকে ইমেল-এ তিনি জানালেন, ভাইরাল হওয়া ছবি কী ভাবে জনমত এবং তার পরের ধাপে সরকারি নীতি নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে, তার সার্থক উদাহরণ আলানের ছবি। তাঁর মতে, ‘‘এ ধরনের ছবি যত বেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, ততই সাধারণ মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারবেন। কারণ, এর ফলে এই ধরনের ছবি জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।’’ যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে জরুরি ভূমিকা পালন করেছিল ‘নাপাম গার্ল’-এর ছবি। ১৯৭২-এর ৮ জুন রাস্তা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যাচ্ছিল ন’বছরের কিম ফুক। দিগন্তে নাপাম বোমার ধোঁয়ার কুণ্ডলী। শরীরে পিছনের অংশটি ঝলসে গিয়েছিল কিমের। আড়াই দশক আগে আর একটি শিশুর ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে। ১৯৯৩-এ খরা-বিধ্বস্ত সুদানে ছবিটি তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্রসাংবাদিক কেভিন কার্টার। একটি কঙ্কালসার শিশুকন্যা কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে, কয়েক হাত দূরেই একটি শকুন, শিশুর প্রাণস্পন্দন থেমে যাওয়ার অপেক্ষায়। শকুনটিকে বাচ্চার কাছাকাছি আসতে দেওয়ার জন্য কুড়ি মিনিট নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছিলেন চিত্রসাংবাদিক। সুদান-সহ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষ-মড়কের দলিল এই ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’ ছবিটি। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখেছিলেন বলেই কি কয়েক মাসের মধ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল কেভিনকে!
এই প্রসঙ্গে খেয়াল করা জরুরি, ২৩ মাসের ভালেরিয়া বা তিন বছরের আলান, এমনকি নাম না-জানা আফ্রিকান শিশু বা নাপাম গার্ল কিম, এদের কেউই মার্কিন বা ইউরোপীয় নয়। তাই কি সহজেই তাদের ছবি মার্কিন বা ইউরোপীয় দৈনিকে ছাপা যায়? কারণ, পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বহু দিনের অভিযোগ, তারা আমেরিকা বা ইউরোপের মৃতদেহকে যতটা ‘মর্যাদা’ দেয়, তার কানাকড়িও তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের মৃতদেহকে দেয় না। তাই প্যারিস জঙ্গি হামলার পরে মৃতদেহের কাপড় ঢাকা দেওয়া ছবি ছাপা হলেও মার্কিন সীমান্তে মৃত শরণার্থী বা আইএস হামলায় নিহত সিরীয় শিশুর মুখের ক্লোজ়-আপ ছাপা হয়ে যায় সহজেই।
সম্প্রতি নিম্যান রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে সমাজতত্ত্ববিদ জেসিকা এম ফিশম্যানের গবেষণাপত্রের একাংশ। আমেরিকার দশটি সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকের সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করে জেসিকা দেখিয়েছেন, মার্কিন সংবাদমাধ্যমে এই ‘দ্বিচারিতা’ যথেষ্ট প্রকট। তিনি লিখেছেন, ‘‘মৃত মার্কিনদের থেকে মৃত অ-মার্কিনদের ছবি অনেক বেশি ছাপা হয় আমেরিকার সংবাদপত্রে, অনেক বেশি দেখানো হয় চ্যানেলে চ্যানেলে। যেন একটা অলিখিত মত রয়েছে যে, বিদেশের মাটিতে কোনও ঘটনা কতটা মর্মান্তিক, তা বোঝা যাবে মৃতদেহের বীভৎসতা দিয়েই। কিন্তু আমেরিকায় কোনও হামলা বা বড় মাপের দুর্ঘটনা হলে খুব সচেতন ভাবে মৃতদেহের ছবি ছাপা থেকে বিরত থাকেন এডিটররা।’’
তবে মৃত শরণার্থীর মর্মান্তিক ছবি ছাপলেই যে শরণার্থী নীতি পাল্টানোর পথটি সুগম হয়ে যাবে, তা মানতে নারাজ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ডেভিড বেনফেল। ইমেল-এ তিনি জানালেন, ‘‘এই ধরনের ছবি দেখে কার কী প্রতিক্রিয়া হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করে সেই মানুষটির উপরে। মানুষটি যদি শরণার্থীদের প্রতি সদয় না-হন, শরণার্থীদের পরিস্থিতি জেনেও তাঁর মনে করুণা বা সমবেদনার উদ্রেক না-হয়, তা হলে এই ছবি তাঁকে আবেগতাড়িত করে তুলবে বলে মনে হয় না। বড়জোর একটা মুহূর্তের খারাপ লাগা তৈরি হবে। কিন্তু তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। দেশের অধিকাংশ মানুষ যদি এমনই হন (না-হলে আর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেন কী করে!) তা হলে এই ছবির কোনও প্রভাব জনমানসে পড়বে না। শরণার্থী নীতি বদলানো তো দূরের কথা!’’
একই আশঙ্কা শোনা গেল শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা ‘কোলিব্রি সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা রবিন রাইনের গলাতেও। তাঁর বার্তা, ‘‘মনে রাখবেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু ক্ষমতায় এসেছিলেন দেওয়াল তোলা, অর্থাৎ ‘আমার-তোমার’ মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করেই। যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছিলেন, তাঁরা মৃত বাবা-মেয়ের ছবি দেখে মনে মনে ভাবেন— এরা তো বেআইনি ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের দেশে ঢোকার চেষ্টা করছিল। আইন ভাঙলে তার মাসুল তো দিতেই হবে!’’
জার্মান সংবাদপত্র ‘বিল্ড’-এর ওয়েব সংস্করণের সম্পাদক জুলিয়ান রাইখেল্টের কথায়, ‘‘বাবা-মেয়ের ওই ছবি তো শুধু ছবি নয়। একটি চিৎকার। নিশ্চিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত, দৈনন্দিনের বাঁধা গতে আবদ্ধ গড়পড়তা মানুষকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত দরকারি এক আর্তনাদ।’’ খরস্রোতা নদীতে তলিয়ে যাওয়ার সময়ে নিশ্চয়ই চিৎকার করেছিলেন অস্কার ও তাঁর শিশুকন্যা। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়েছিলেন ভালেরিয়ার মা তানিয়া-ও।
শুনেছে কে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy