সর্বভারতীয়: রাঁচীতে হেমন্ত সোরেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিটিআই
এক বছর আগের জানুয়ারি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে ব্রিগেডের মঞ্চে হাজির বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির তাবড় নেতারা— কাশ্মীরের ফারুক আবদুল্লা থেকে কর্নাটকের এইচ ডি দেবগৌড়া, মহারাষ্ট্রের শরদ পওয়ার থেকে বিহারের যশবন্ত সিংহ, দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবাল। মোট ২৩ জন সর্বভারতীয় নেতা ছিলেন সেই সমাবেশে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিতে চাইছেন, সেটা বুঝতে কোনও সমস্যা ছিল না।
আর এই জানুয়ারিতে, রাজস্থানের জনসভায় মমতাকেই প্রধান নিশানা করলেন অমিত শাহ। নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রশ্নে তাঁর বিরোধিতার প্রাবল্য এতখানিই যে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে থেকেও তিনি দারুণ রকম উপস্থিত। এক বছরের মধ্যে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজের বড় জায়গা করে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নরেন্দ্র মোদী-পর্বে সর্বভারতীয় বিরোধী-রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নেওয়ার কাজ অবশ্য মমতা এর আগেই শুরু করেছিলেন। ডিমনিটাইজ়েশন বা নোটবন্দির বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের নেতাদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশে মিছিল করেছেন ২০১৬-র নভেম্বরে। কিন্তু, আজ গোটা দেশের রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্বের পিছনে রয়েছে গত কয়েক মাসের ঘটনাক্রম। এনআরসি নিয়ে তিনি বিজেপির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতের পথে হেঁটেছেন। যখন ঘোষণা করেছেন যে কোনও অবস্থাতেই পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করতে দেবেন না, তখন কি তিনি শুধুই এই রাজ্যের ভোটারদের উদ্দেশেই কথা বলছিলেন— সর্বভারতীয় শ্রোতাদের কথা তাঁর মাথায় ছিল না? সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। নাগরিকত্ব বিলের প্রশ্নেও গোটা দেশে সবচেয়ে বেশি সরব তিনিই। কলকাতায় গোটা পাঁচেক মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মমতা— দেশ জুড়ে প্রতিবাদকারীরা তাঁকে দেখে ভরসা পেয়েছেন। নাগরিকত্ব আইনের প্রশ্নে তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে গণভোটের দাবি করেছেন। তিনিও বিলক্ষণ জানেন, সেই গণভোট অসম্ভব। তাঁর এই অবস্থানকে তাই আক্ষরিক অর্থে না দেখে রাজনৈতিক ভাবে দেখা প্রয়োজন— তিনি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন, গোটা দেশেই যাঁদের কথা কেউ বলার নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করছেন, করবেন।
গত সেপ্টেম্বর থেকে মমতা যখন এই পদক্ষেপগুলো করছেন, লোকসভা নির্বাচন তখন পাঁচ বছর দূরে। স্পষ্টতই, তিনি নিজেকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন, যাতে গোটা দেশে তাঁর এমন একটা ভাবমূর্তি গড়ে উঠতে পারে যে তিনিই বিজেপি শাসনের যাবতীয় বিপদ থেকে ভারতকে রক্ষা করতে পারেন। গোটা দেশকে তিনি বলছেন, সম্মিলিত তৃতীয় ফ্রন্ট যদি তৈরি হয়, তাঁকে ঘিরেই তা তৈরি হবে।
সত্যিই কি মমতার সর্বভারতীয় উচ্চাশা পূরণ হবে? নিজের রাজ্যে প্রবল পরাক্রান্ত নেত্রী, কিন্তু জাতীয় মঞ্চে অকিঞ্চিৎকর— এই পরিচিতির বাধা টপকানো কি সম্ভব? আমি বেঙ্গালুরুর সাংবাদিক— বলতেই পারেন, দিদিকে নিয়ে এই আলোচনা অনধিকারচর্চা। কিন্তু, এই অবস্থানগত দূরত্বের কারণেই কিছু জিনিস চোখে পড়ে, যা হয়তো রাজ্যের প্রাত্যহিকতায় জড়িয়ে থাকলে দেখা মুশকিল হয়। সম্পূর্ণ বাইরের লোক হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্ভাবনাকে বাইরের রাজ্যের বহু মানুষ কী ভাবে দেখছেন, সেটাই বলার চেষ্টা করছি।
পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে পাল্টানোর ক্ষমতা মমতার অসাধারণ। শরদ পওয়ার আর লালুপ্রসাদ যাদবকে বাদ রাখলে এই একটা প্রশ্নে গোটা ভারতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুল্য রাজনীতিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকতে জানেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এখানে— তিনি যত বার নিজের রাজনীতির মোড় পাল্টেছেন, কখনও জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন হন না।
কাল না হোক পরশুর পরের দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন শিবিরে থাকবেন, বলা অসম্ভব। তিনি ইউপিএ-তে থাকতে পারেন, তৃতীয় ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিতে পারেন, এমনকি মোদীহীন এনডিএ-তে থাকাও আশ্চর্য নয়। মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে— যিনি যে কোনও দিকে চলে যেতে পারেন, তাঁর জেতার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। মহারাষ্ট্রে শরদ পওয়ার যা করতে পেরেছেন, মমতা গোটা দেশে তা পারবেন না, বলা যায় কি?
ভারতীয় রাজনীতি এখন বিজেপির অক্ষে বিভক্ত। এই দেশের রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ হতে গেলে তিনটে বিকল্প আছে— এক, বিজেপি-তে থাকা; দুই, বিজেপির তাৎপর্যপূর্ণ সহযোগী হওয়া; এবং তিন, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিজেপির বিরোধিতা করা। প্রথমটা ছেড়ে শেষ দুটো বিকল্পেই দিব্যি মানিয়ে নিতে পারবেন মমতা— যে হেতু তাঁর রাজনীতি আদর্শ-কেন্দ্রিক নয়, ফলে তাঁর পক্ষে যে কোনও শিবিরে মানিয়ে নেওয়া সহজ। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ যদি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, একমাত্র তখনই দেশের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাৎপর্যহীন হবেন। মনে রাখা ভাল, নেহরুর পর আর কারও সেই কৃতিত্ব নেই। দেশে অর্থনীতি বেহাল, বেকারত্ব বাড়ছে। এবং, সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলো যদি কোনও মাপকাঠি হয়, তবে বলতেই হবে যে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বিজেপির আসন কমার সম্ভাবনা বিপুল। ফলে, ২০২৪ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরতে হলে অ-বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে দারুণ ভাবে জিততে হবে বিজেপিকে। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সর্বাগ্রগণ্য। মমতাকে ধরাশায়ী করে বিজেপি অতি সহজে জিতে আসবে, অন্ধ মোদীভক্তও এমন বাজি ধরতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে মমতাকে সহজে মুছে দেওয়া যাবে না, এই কথাটা জোর দিয়ে বলছি তিনটে কারণে। প্রথম কারণটা আগেই বলেছি— গত প্রায় চার দশকে কখনও তিনি নিজের জনসমর্থনভিত্তি হারাননি। দ্বিতীয় কারণ, রাজ্য রাজনীতিতে মমতার নিজস্ব ব্র্যান্ড আছে। নবীন পট্টনায়ককে বাদ রাখলে তিনিই এখন দেশে সবচেয়ে বেশি সময় মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে আছেন। মোদী যেমন হিন্দুত্ব আর গুজরাত মডেলের মিশেলে নিজের রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সর্বজনীন উন্নয়ন নিয়ে মমতাও নিজের বিকল্প মডেল তৈরি করছেন— ভুললে চলবে না, দেশের বহু রাজ্যে যখন দারিদ্র বাড়ছে, পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র কমেছে অনেকখানি। তৃতীয়ত, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যে তুমুল মোদী-ঝড় উঠেছিল, তা-ও কিন্তু মমতােক ধূলিসাৎ করতে পারেনি। তাঁর আসন কমেছে, কিন্তু তিনি মুছে যাননি। ২০২১-এর বিধানসভা যদি তিনি সামলে দিতে পারেন, তবে আগামী লোকসভা নির্বাচনের জন্য তাঁর হাতে সময় থাকবে অনেকখানি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এই সম্ভাবনা যত প্রকট হবে, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর ভোটও তত বাড়বে, অনুমান করা যায়।
মমতার সাংগঠনিক ক্ষমতা অসাধারণ। যেখান থেকে শুরু করে তিনি যেখানে পৌঁছেছেন, এই ক্ষমতা ছাড়া সেটা সম্ভবই হত না। সম্প্রতি তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, সংগঠনের দিকে তেমন নজর দিতে পারেননি। তার ফল কী হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তিনি বিলক্ষণ দেখেছেন। গত তিন দশকের অভিজ্ঞতাকে সত্যি মানলে বলতে হয়, মমতা এটা সামলে নিতে পারবেন। তিনি জানেন, ঘরে বসে নির্বাচন জেতা যায় না। তার জন্য পদাতিকদের প্রয়োজন। এবং, সেই তৃণমূলস্তরের কর্মীদের কাছে ‘দিদি’র গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ এখনও নেই।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বাড়বে, এমনটা মনে করার সবচেয়ে বড় কারণ হল, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ— ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী মানুষ— এক জন নেতার অপেক্ষায় রয়েছেন। এমন নেতা, যিনি নরেন্দ্র মোদীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কার্যত তাঁর প্রেসিডেনশিয়াল ধাঁচের রাজনীতির পাল্টা দিয়ে, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেন। মমতা নিজের ধর্মনিরপেক্ষ, বস্তুত মুসলমান-দরদি, ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছেন। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর লড়াকু চেহারা দেশের চেনা। সিঙ্গুরের ঘটনা বলবে, বড় কর্পোরেটের সামনেও তিনি সমান লড়াকু। কাজেই, ভারতের বিকল্প নেতা হয়ে ওঠার সুযোগ তাঁর আছে।
মোদী-বিরোধিতা তাঁকে যত দূর নিয়ে যাওয়ার, যাবে। কিন্তু, তার পরের ধাপটা পেরোনোর জন্য একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প তৈরি করতে হবে তাঁকে। সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায়, ভঙ্গিতে সেই বিকল্পের কথা বলতে হবে। এবং, তাঁকে ঘিরে যে অভিযোগগুলো এখনও আছে— দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ, সহিষ্ণুতার অভাবের অভিযোগ, অস্থিরমতিত্বের অভিযোগ— সেগুলোকে অতিক্রম করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy