ছবি: সংগৃহীত
গত ২০ জানুয়ারি ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে আমাদের ডার্বি ম্যাচ হল। আমাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলকে ২-১ গোলে হারিয়ে মনটা খুশিতে ভরে গেল। এই জয় যতটা আনন্দ আমায় দিল, মনে হল সব মোহনবাগানিদের তাই-ই দেবে। ঠিক ততটাই দুঃখে মনটা ভরে দিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠেও রাজনীতির প্রবেশ।
যখন থেকে ফুটবল নিয়ে জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে এবং নবদ্বীপের মাঠে খেলেছি, কৈশোরে এবং যৌবনে তখন থেকেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের বন্ধুত্বপূর্ণ রেষারেষি দেখে এসেছি। কখনও আমরা জিতেছি এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক, আমার সহপাঠী, খেলোয়াড় বন্ধু তাদের দলও জিতেছে। যত রেষারেষি, যত উন্মাদনা সেটা খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও টিভির যুগ শুরু হয়নি, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলার দিন আমরা কারও বাড়িতে দলবদ্ধ ভাবে রেডিয়োর সামনে বসে খেলা উপভোগ করতাম। খেলা যখন দেখতাম, তখন আমরা যারাই জিততাম, একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করে তক্কাতক্কি করতাম। সেই সময়ে সাতের দশকে আমরা কেউ হাবিব বা আকবর, নঈম, সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুব্রত ভট্টাচার্যর ফ্যান ছিলাম। নিজেদের মধ্যে রসিকতা করতাম, একে অপরের পিছনে লাগতাম। কিন্তু কখনওই সেটা হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠেনি। খেলার রেষারেষিতে ঝগড়া হত বটে, কিন্তু দুয়েক দিনের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যেত। সে সময়ে বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ভেদাভেদ না বুঝে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কারও বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে আমরা একে অপরকে টিটকিরি দিতাম। কিন্তু সেটা কখনওই শালীনতা ছাড়িয়ে যেত না।
সত্তরের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত সেই সময়ে আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, যাঁরা কেউ আমাদের ক্লাবের কিংবা বিরোধী ক্লাবের সমর্থক— তাঁরা একসঙ্গেই কলকাতায় খেলা দেখতে গিয়েছি। একসঙ্গেই ফিরেছি। কখনও আমরা জিতেছি, কখনও তারা জিতেছে। কিন্তু খেলার মাঠের উন্মাদনা এবং ক্লাবের প্রতি ভালবাসায় আবেগের বশে যে রেষারেষির সৃষ্টি হত, বাড়ি ফিরলে সে সব নিয়ে আর কোনও রেষারেষি থাকত না। বন্ধুত্বটাই বড় হয়ে দাঁড়াত।
দুটো ঘটনার কথা এখনও মনে আছে। প্রথম ঘটনাটার সাল ঠিক মনে নেই। সেই সময়ে নিয়ম অনুযায়ী মোহনবাগান এবং মহামেডানের একটা খেলা নিষ্পত্তি না হওয়ার দরুণ পর পর তিন দিন খেলা হয়েছিল। ভাল খেলা দেখার লক্ষ্যে আমরা যাঁরা মোহনবাগানি ছিলাম, আমাদের সঙ্গেই আমাদের যাঁরা ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বন্ধু ছিলেন, তাঁরাও গিয়েছিলেন।
আমরা কখনও আমরা-ওরা বিচার করিনি।
আরেকটা কথা আজ মনে পড়ছে। ১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ডে যে বার আমরা ইস্টবেঙ্গলের কাছে ৫-০ গোলে হেরেছিলাম, সে বার ইস্টবেঙ্গলের বন্ধুরা আমাদের নিয়ে খুব হাসাহাসি-টিপ্পনি করেছিল। কিন্তু আমাদের মানসিক বিধ্বস্ততার কথা উপলব্ধি করে পরবর্তীতে তাঁরা আমাদের সঙ্গে বিষয়টা মিটিয়ে নেন। আবার বন্ধুত্বসুলভ মানসিকতায় আমরা মিশে গিয়েছিলাম। সেটা কখনওই শালীনতা ছাড়িয়ে যায়নি।
আরেকটা কথা মনে পড়ে। ১৯৭৬ সালে আমরা ইস্টবেঙ্গলকে কলকাতা লিগে হারিয়েছিলাম, যেটা আমাদের মনে খুব বল এনে দিয়েছিল। আমরা নবদ্বীপের পীড়তলার খাল থেকে একটা বিশাল বড় নৌকা সেই আমলের গরুর গাড়ির উপরে তুলে তাতে ফুল-মালা দিয়ে সাজিয়ে ইলেকট্রিক লাইট ও বাদ্যযন্ত্র সহকারে রাত্রিবেলায় সারা শহর প্রদক্ষিণ করেছিলাম। ফিরে এসে আমরা রাত্রিবেলায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সমর্থকেরা খেলোয়াড়-সুলভ মনোভাব দেখাই। একসঙ্গে মাংস-ভাত খেয়ে পিকনিক করেছিলাম। কখনও আমরা এ বিষয়ে বিদ্বেষমূলক মানসিকতা পোষণ করিনি।
তখন ডার্বি কথাটার প্রচলন ছিল না। আর তখন এত ঘন ঘন সাক্ষাৎও হত না। সেই কারণে সারা বছর ভারতের আপামর বাঙালির হৃদয়ে এই খেলা নিয়ে একটা উন্মাদনা তৈরি হত। যেটা এখনও হয়। বিভিন্ন কারণে এখন আর কলকাতার মাঠে খেলা দেখতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। সময়-সুযোগ পেলেই মোহনবাগানের খেলা বা অন্য খেলা টিভির সামনে বা মোবাইলে দেখতে বসে যাই। মোহনবাগান এ বছর যা খেলছে, আই লিগে, যেটুকু খেলা বুঝি তাতে সেটা আমার কাছে অনবদ্য লেগেছে। যৌবন কালে স্থানীয় লিগে ফুটবল ক্রিকেট কিছুটা খেলেছি, সেই নিরিখে বলতে পারি, আমাদের ক্লাব বেশ কয়েক বছর পর একটি কুশলী খেলোয়াড় সমৃদ্ধ দল হিসেবে তৈরি হয়েছে। নেরকার সঙ্গে খেলাটা তো অনবদ্য। আশা করছি, এই বছর আমরা আই লিগ জিতবই।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল একে অপরের পরিপূরক। দু’জনেরই দু’জনকে দরকার। না হলে এই উন্মাদনা সৃষ্টি হবে না। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের কিছু উগ্র সমর্থক সোশ্যাল মিড়িয়ায় আলোচনা এমন কুরুচিকর অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছেন, যেটা এক জন ক্রীড়াপ্রেমী হিসাবে আমার কাছে বড়ই বেদনার। খেলার মাঠে খেলাসুলভ রাজনীতি থাকতেই পারে, কিন্তু হুজুগে রাজনৈতিক পরম্পরা এখন চলছে। সেটাই বেদনাদায়ক।
২০ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় খেলার ছবির সঙ্গে যে রাজনৈতিক তরজা ছবি দেখলাম, সেটা আমার কাছে খুব হতাশাজনক মনে হচ্ছে। এনআরসি ঠিক না বেঠিক, সে বিতর্ক থাকতেই পারে। এবং এই বিতর্ক হওয়াও উচিত। কিন্তু তাই বলে সেটা খেলার মাঠে প্রবেশ না করানোই বাঞ্চনীয়। খেলার মাঠে আনন্দ করে খেলা উপভোগ করাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এখানে রাজনৈতিক কচকচানি টেনে আনবেন না।
সভাপতি, নবদ্বীপ মেরিনার্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy