লকডাউনের দ্বিতীয় দফা শুরু হল যখন, তপন দাসের সংসারের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল রুবিয়া নারগিসের। তপন রুবিয়াদের অফিসের কর্মী। রুবিয়া তাঁকে কিছু টাকা পাঠিয়ে বলেন, অফিস খুললে ফের সাহায্য করবেন। তপন বলেন, “দিদি অফিস খুললেও বিপদ। অফিস পাড়াতেই মসজিদ। কিছু দূরে একটা মুসলমান পাড়াও আছে। ওরাই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেশের সর্বনাশ করল।”
দৈনন্দিন কাজের মধ্যে রুবিয়াকে দেখতে দেখতে তপন ভুলে গিয়েছেন, রুবিয়াদিদিও অভিযুক্তদের দলের লোক। তাঁর আর দোষ কী— মুসলিম বিদ্বেষ যে করোনাভাইরাসকেও হারিয়ে মহামারির আকার নিচ্ছে, টের পাচ্ছেন রুবিয়া। তিরুপতি মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন চার হাজার মানুষ, ট্রেন-বাস বন্ধ থাকায় আটকে পড়েছিলেন, পরে গাদাগাদি করে বাসে চড়ে ফেরেন। সবই নাকি বিধিনিষেধ মেনে! নিয়ম কেবল মানেননি মুসলমানেরা। নিজামুদ্দিনে লুকিয়ে, গলাগলি-কোলাকুলি করে দেশে ভয়াবহ সংক্রমণ ছড়িয়েছেন। কথাগুলো নানা বয়ানে শুনেছে রুবিয়া। তপনও সেই গেরুয়া রাজনীতির শিকার।
হোস্টেল বন্ধের নোটিস পেয়ে বন্ধু তনুশ্রীর বাড়ি গিয়েছিল কলকাতার কলেজে পড়তে আসা রিফাত নাহার। হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় বাড়ি ফিরতে পারেনি। দুই পরিবারের সমস্যা ছিল না। কিন্তু প্রতিবেশীদের চাপের মুখে নত হতে হয় তনুশ্রীর পরিবারকে। মেয়েটি কী করে বাড়ি ফিরবে— ভাবেননি তাঁরা। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে রিফাতকে অর্ধেক পথ পৌঁছে দেন তনুশ্রীর বাবা। রিফাতের আত্মীয় এসে নিয়ে যান বাকি পথ।
ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে নিজামুদ্দিনে জমায়েত অবশ্যই অপরাধ, কিন্তু প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নিজামুদ্দিনের দেওয়াল ঘেঁষেই পুলিশ ফাঁড়ি। কী করে তাদের নাকের ডগায় এত বড় জমায়েত চলল? ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল ১৩ থেকে ১৫ মার্চ। বিশ্বের বহু দেশের মানুষ যোগ দিতে এসেছিলেন। এই বিদেশিদের ঢোকার অনুমতি দিয়েছিল কেন সরকার? এত মানুষের একত্রে থাকার কথা জেনেও পুলিশ বা প্রশাসন কেন কিছু করল না? তবলিগ জামাত প্রেস বিবৃতিতে বলেছে, সাতটা বাস নানা রাজ্যে ফেরার ছাড়পত্র চেয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, উত্তর আসেনি। মনে রাখা ভাল, করোনাভাইরাস যে ভারতে ‘স্বাস্থ্য ইমার্জেন্সি’ নয়, ১৩ মার্চ তা ঘোষণা করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
ও দিকে, ১৯ তারিখ পর্যন্ত খোলা ছিল তিরুপতি মন্দির। সেখানে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ হয়েছে। বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে কত মানুষ আটকে পড়েছিলেন। তাঁদের পরীক্ষা হয়েছে? রিপোর্ট কী? সে খবর চোখে পড়েনি। লকডাউন ঘোষণার পরেও অযোধ্যার রামলালাকে নিয়ে সপার্ষদ যাত্রা করেন যোগী আদিত্যনাথ। তিনিই নিজামুদ্দিনে আটকে থাকা মুসলিমদের ‘মানবতার শত্রু’ বলেন। আবার, মধ্যপ্রদেশে ২৩ মার্চ নতুন সরকার গঠন করে বিজেপি। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে সংবর্ধনা জানাতে বিপুল লোক সমাগম হয়। বিশ্বসুদ্ধ লোক যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, ভারতে এসে তার নাম হল ‘করোনা জেহাদ’! তা নাকি মুসলিমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়াচ্ছে।
আসলে, করোনা অতিমারির আগেও একটা বড় পর্ব রয়েছে। নয়া নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) যে বৈষম্যদুষ্ট, সে বিষয়ে জনমানসে সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। গত ১৫ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির শাহিনবাগে শত শত মুসলিম মহিলা সিএএ-র বিরোধিতা করে অবস্থান শুরু করেন। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। লকডাউন ঘোষণার আগে অবধি কয়েক ডজন অবস্থান চলছিল। এগুলো শেষ অবধি আর মুসলিম মেয়েদের অবস্থানে আটকে ছিল না। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল। সরকারি দমন-পীড়নেও বিক্ষোভ প্রশমিত না করতে পেরে ত্রাস সঞ্চারের জন্যই দিল্লি দাঙ্গা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। করোনা পর্বের বিদ্বেষ সংক্রমণ সেই চলমান প্রক্রিয়ারই অংশ।
মহারাষ্ট্রের পালঘরে গণপ্রহারে যখন দুই সন্ন্যাসী ও তাঁদের চালকের প্রাণ গেল, তাতে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। শেষ অবধি পুলিশ ১১ জনকে আটক করার পর মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখ জানালেন, হামলাকারী ও আক্রান্তেরা একই সম্প্রদায়ের লোক। আসলে, কিছু লোকের অপরাধে, কিংবা তাঁদের অপরাধী বলে সন্দেহের বশে, গোটা সম্প্রদায়কে অপরাধী দেগে দিলে সমাজে মুসলিম বিরূপতা জাগিয়ে তোলা হয়। তবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারীদের ধরার পর বহু অসত্য খবরের প্রচারে দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়েছেন। চাপের মুখে প্রমাণ দিতে না পেরে কোনও কোনও সংবাদপত্র ক্ষমাও চেয়েছে। তবু রমজান মাসে ভুয়ো খবর ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। অতীতের ইফতার পার্টি বা মসজিদে তারাবির নমাজের ছবি দেখিয়ে তা এই লকডাউন পর্বের জমায়েত বলে প্রচার করা হতে পারে। সহ-নাগরিকেরা সচেতন না হলে বিদ্বেষের রাজনীতি থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে কি?
বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy