—ফাইল চিত্র
কেরলের শ্যামল সরোবরে একটি অবোলা প্রাণী যে বীভৎসতায় মৃত্যুতে মিশে গেল, তার সঙ্গে ‘পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক’ সিনেমায় ‘জ়ম্বি’র জ্যান্ত জীবকে ছিঁড়ে খেয়ে নেওয়ার সেন্সর করা দৃশ্যগুলোর কী অশুভ সাদৃশ্য! আকস্মিক বিহ্বলতায় এও মনে হয়েছিল, কোভিড-১৯ যেমন ভয়াবহ ভাবে নিজেকে ‘মিউটেট’ করতে পারে, কে জানে, তেমনই সাংঘাতিক জিনগত বদল ঘটিয়ে মানুষ ক্রমে জ়ম্বি অর্থাৎ পিশাচ হয়ে যাচ্ছে না তো? েসই তারাই হয়তো ছিল ভগবানের দেশের সাইলেন্ট ভ্যালির নিথর সৌন্দর্যের আড়ালে!
ঠিক এইখানেই— এইখানে এসেই বাস্তবের এক থাপ্পড়ে সিনেমার কল্পদুনিয়া, দুঃস্বপ্নের ঘোর খানখান হয়ে গিয়েছে। কারণ, অভিজ্ঞতা বলে, চরাচরের তাবৎ জীবকুলের সঙ্গে এমন হিংস্র ষড়যন্ত্র একটি মাত্র প্রজাতিই করতে জানে। হাতিই হোক, আর বুনো শুয়োরই হোক, প্রতিবেশী জীবকে এ রকম ঠকিয়ে মারার আর তারিয়ে দেখার নৃশংস ছক কষার মান আর হুঁশ সেই দুর্বৃত্তেরই আছে। যারা প্রকৃতির সম্পদ, অন্য প্রাণীর আহার্য অস্তিত্ব আর জীবন খুঁচিয়েছে বারে বারে। তার সৌজন্যেই অরণ্যের খাদ্যশৃঙ্খল চুরমার। তার প্রতাপেই আশ্বস্ত হয়ে অসহায় ঐরাবত লোকালয়ে খাবারের আশায় এসে শোণিতের স্রোত উগরে মরেছে। তার তাণ্ডবেই অভুক্ত বাঘ জনবসতিতে এসে খাবার ছিনিয়ে নিতে গিয়ে অন্দরমহলের গালচে হয়ে গিয়েছে। বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিদ্যুৎচাবুকের ঘা খেয়ে অবাক হওয়ারও আগে গ্যাঁজলা তুলে স্থির হয়ে গিয়েছে কত বন্যপ্রাণ। মোবাইলের মিনার থেকে ছোড়া বিষমাখা তরঙ্গতিরে ঝাঁকে ঝাঁকে মাটিতে আছড়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ পক্ষিকুল। জঙ্গলের গর্ভগৃহ পর্যন্ত করাত আর চাকা ছুটিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এসেছে হরিণ, হাতি, চিতার খণ্ডবিখণ্ড লাশ। তার পর যুক্তিসম্মত প্রশ্ন করেছে, ওরা কেন রেলের সিগন্যাল দেখতে শেখেনি? ঠিক যেমন আজ ফসল নষ্ট থামানোর অজুহাতে ফলের মধ্যে বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। ঘুমপাড়ানি গুলির বদলে রাইফেলে প্রাণঘাতী গরম বুলেট পুরলে যেমন অবনী বাঘিনির হন্তারকের শিকারি-জিন চেনা যায়, ঠিক তেমনই সুগন্ধি ফলের মধ্যে প্রতিরোধের নামে প্রতিহিংসার বারুদ ঠেসলেই ‘মানুষ’ নামে ডাকা যায়।
আচরণবাদের বিজ্ঞান জানাচ্ছে, একটি প্রজাতি কতখানি খুনখার বা অপ্রাকৃতিক, তা নিরূপণে স্বজাতি-পরিমণ্ডলে, স্বাভাবিক পরিবেশে তার ভাবগতিকের নিরীক্ষা করা হয়। এই ফর্মুলায় বিচার করলে, সবার উপরে মানুষ ভণ্ড, তাহার উপরে নাই। মানুষ যে যুগ-যুগান্ত ধরেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নরখাদক, সে তো আমরা জানিই। নিশ্চয় ভোলেননি, নয়ডার দুই ক্ষুধার্তের দু’জোড়া নির্বিকার চোখ? মনিন্দর সিংহ পান্ধের আর সুরিন্দর কোলি। ওদের বাড়ির ড্রেনে বইত সমাজের টাটকা রক্ত। আর নির্ভয়ার চিতার আগুনে মুহুর্মুহু ঘি ঢালত আইনের যে দিগ্গজ! তার কৌশল-প্রকৌশল সবই কালো কোট ছাড়লেই আসলে আসামি বাসচালক মুকেশের জং-ধরা ভোঁতা রডের মতো সেই মন্তব্য বনে যায়, ‘অত রাতে ঘুরছিল, মেয়েটা খারাপই ছিল।’
শিক্ষার অপদেবতা এক লাফ দিয়ে অশিক্ষার অতল আঁধারে ডুবে যায়। যেখানে গরাদ ধরে হুঙ্কার ছাড়ে কত রাম রহিম, আসারাম, সুইনি টড। কোভিড-১৯ তো আয়না মাত্র। তার প্রতিবিম্বে নজর আটকালে গায়ে কাঁটা দেয়— লোভ, কাম, রিরংসা, বিদ্বেষের ভাইরাসে মানুষ তো কত শতাব্দী আগেই পিশাচ হয়ে গিয়েছে। তাই তো লকডাউনের প্রথম প্রহরে বাইক চড়ে মজা গুনতে বেরোয় মানুষ? যাই দেখে আসি, লোকজন কেমন ওষুধ আর রুটির জন্য মারপিট করছে।
এই প্রবৃত্তিকে কী যেন বলেন ধর্মাবতার? পাশবিক? জান্তব? আজ্ঞে না, কোনও জন্তু, পশু, কীট এ কাজ করে না। একেই বলে চারপেয়েদের কীর্তি, তাই আদতে এগুলোই ‘মানবিক’। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, এমন আচরণের কারণ অবদমিত মনোজগৎ। সেই জটিল কুটিল মনন তো এখনও মানুষ ছাড়া কোনও প্রাণীর নেই। অবচেতনের চমকে-শিউরে ওঠা ইচ্ছেগুলো চেতন-দশায় সব সময় অবাধে পূরণ করতে পারে না, তাই অপেক্ষা করে সুযোগের। ঘুরপথে আক্রোশ আর নৃশংসতার রূপে সেগুলো বার বার পূরণ করতে চায়। কখনও একাই তৃপ্তি পেতে চায়, কখনও সে ইচ্ছা চরিতার্থ করে দলবদ্ধ ভাবে। যূথবদ্ধ হলেই তার ব্যক্তিগত বা ভয়জনিত শীলতার খোলস ছেড়ে নখদাঁত বার করে আদিম রিপু। এই তত্ত্বেই মেলে সেডিজ়ম, অপরাধপ্রবণতা আর গণরোষের উৎস।
এই কারণেই অন্যের পথে পেরেক পোঁতে, এই কারণেই জোয়ান অব আর্ককে জ্বালিয়ে মারে, এই কারণেই গোরক্ষকরা তেড়ে আসে, এক দল জাতধর্মের ডান্ডা মেরে অন্যদের ভিটেমাটিছাড়া করে, আর আইনপ্রভুরা জর্জ ফ্লয়েডদের শ্বাস চেপে ধরে হাঁটুর ভাঁজে।
আজ যে রাস্তায় করোনা মানুষের অপেক্ষায় ওত পেতে বসে, আগের শতকে সেখানেই থাবা মেলেছিল প্লেগ। এক বিদেশিনি সেখানে প্রাণমায়া তুচ্ছ করে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে ভারতসন্তানের দুধেভাতে থাকার বন্দোবস্ত করতেন। তাঁকে দেখামাত্র, ধড়াম ধড়াম বন্ধ হত দরজাগুলো। আর তিনি চলে গেলে তাঁর ব্লিচিং দেওয়া রাস্তায় ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল ঢালা চলত। ১৮৯৯ সালে সিস্টার নিবেদিতাকে এই ভাবে আঘাত দিত যারা, তাদের থেকে একটি পাও এগোয়নি ২০২০ সালের মূর্খ ভারতসন্তানরা, যারা খোদ রক্ষাকর্তা স্বাস্থ্যসেবীদেরই দূর দূর করে তাড়াচ্ছে!
গত ১২১ বছরে শুধু গুণিতকের হিসাবে বেড়েছে প্রমাণ, সাক্ষ্য। সেই সব প্রমাণ দেখিয়েছে হাজারে হাজারে লক্ষ কোটি ‘রেয়ারেস্ট অব দ্য রেয়ার কেস’। বুঝিয়েছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুতবেগে উধাও হয়ে চলেছে মনুষ্যত্বযুক্ত মানুষ। তবু গভীরতম অসুখেও তো কোনও দিন একটু শরীর-মন চাঙ্গা লাগে, তেমনই প্রগাঢ় অন্ধকারের পর্দা সরে কদাচিৎ সূর্যও দেখা দেয়। আর ওঁদের হঠাৎ পাওয়া যায় রাস্তার মোড়ে, মলিন দোকানে, বাসস্টপের বিষণ্ণ ভিড়ের পাশটিতে।
দেশ তালাবন্দি হওয়ার সামান্য আগে, খবর হয়েছিলেন আজ়ম খান। বেঙ্গালুরুর ট্যাক্সিচালক, কষ্টের রোজগার বাঁচিয়ে মাস্ক কিনেছেন। যাত্রীরা উঠলেই হাতে হাতে তুলে দিচ্ছেন। শুনলাম, উনি ট্যাক্সি চালান, তবু নরমমনা। বিশেষ সম্প্রদায়ের, তবু ‘ওদের’ মতো বিপজ্জনক নন। হুগলির আশাকর্মী আবিদা ভাবি-তে মজল বাঙালি। ভিন্ রাজ্য ফেরত আমানউল্লা, জ়াকিররা যাতে নিভৃতবাসের নিয়ম মানেন, কড়া পাহারা দিচ্ছেন তিনি। ইনদওরের দ্রৌপদীবাই জ্বর-শ্বাসকষ্টে মারা গেলে তাঁর আত্মীয়দের মধ্যে যখন লকডাউন মেনে চলার হিড়িক, শবাধার কাঁধে নিলেন মুসলিম প্রতিবেশীরা। ওঁরা সবাই আশ্চর্য মানুষ, সবাই দৃষ্টান্ত।
আশ্চর্যই বটে। ওঁরা যা করেছেন তা মানুষেরই কাজ বলে জানা ছিল। তবু সে কাজ করে ওঁরা সকলের চেয়ে ‘আলাদা’। তাই পশ্চিমি মিডিয়াও তোলপাড় স্কটল্যান্ডের মুসলিম দম্পতি আশিয়া ও জাওয়াদ জাভেদকে নিয়ে। যাঁরা নিজেদের স্টেশনারি দোকানের পুঁজি বাজি রেখে সাবান, স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক কিনছেন, আর বিলিয়ে দিচ্ছেন প্রবীণ অথর্ব নাগরিকদের। এ দেশেও আছে। সোনু সুদ পরিযায়ীদের বাড়ি ফেরালেন, ত্রাণ জোগালেন। তাঁর গুণগানে বলা হল, ‘ছোট মাপের অভিনেতার কত বড় মন’! এই এক মানবসভ্যতা যেখানে মানুষের করণীয়টুকু করলেই অতিমানবের তকমা পাওয়া যায়! দোকানদার, পার্শ্ব চরিত্রের শিল্পী, সন্দেহভাজন পদবির লোকেরা এমন ভাল কাজ কী করে করলেন— এই অসুস্থ বিস্ময়ের সম্মুখীন হতে হয়।
লকডাউনের মনুষ্যমুক্ত সুস্থ বাতাবরণে শান্তিতে উড়েছে, ঘুরেছে পশুপাখির দল। অবশ্য মুদ্রার উল্টো পিঠের দুঃসংবাদটাও শুনুন। ওই একই নীরবতা, নির্জনতা ও নিষ্কলুষ আবহের সুযোগে বনানী নিবিড়ে চোরাশিকারও বেড়েছে ১৫১%। আজ লক-আনলকের চক্রব্যূহে নিরন্তর পাক খেতে খেতে কলির কৌরবদের এ হেন ক্রূর নীতিতে শিয়রে শমনের দেখা পাই।
এর পর কী? সত্যিই খিদের জ্বালায় পাশের লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সভ্যতা? সেই ভয়ঙ্করের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই নিউ নর্মালের খাঁচাবন্দি যাপনে, জীবন ও জীবিকার জন্য তড়পাতে তড়পাতে হাতড়াতে থাকব আরও ক’জন আজ়ম খান, আয়েশা, জাওয়াদদের জন্য?
কাল বাজারে চাল না পেলে, হাঁটার ক্ষমতা হারালেও, ‘এ নেগেটিভ’ রক্ত লাগলে, করোনা পজ়িটিভ হয়ে গেলে, সবাই যখন দুয়ার দেবে, ওঁরা নিশ্চয়ই আসবেন জাত, রং, নিজের নিরাপত্তার সব সীমানা টপকে!
ওঁরা অবশ্য সংখ্যায় বেশি নন। বড় বিরল প্রজাতি।
বাকি যারা এক বিকেলে থালা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করেছিল, সেই সকালে মদিরাবিপণির সামনে দাঁড়িয়ে আকর্ণ হেসেছিল, আর করোনা-ভীতির চরম ঊর্ধ্বযামেই গণপরিবহণের নিরাপদ সুষ্ঠু বন্দোবস্তের পরিবর্তে অফিস-কাছারি আর অগণন ছাড়ের লকগেট হাট করে খুলে অসহায়ের কলিজা, হাঁটু আর ইমিউনিটির ‘আত্মনির্ভরতা’র মাপ নিয়েছিল— তারাই যে শেষ ডোডোপাখিটির মাংস খেয়েছিল পরম তৃপ্তিতে।
এই ধ্বংস-প্রহরে তাই ভাইরাসকে নয়, মানুষকেই ভীষণ ভয় করে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy