এই জলাশয় ঘিরেই ছিল রাজার প্রাসাদ। নিজস্ব চিত্র
মধ্যযুগে এক কবি রাজনৈতিক কারণে অভিবাসী হয়েছিলেন। তাতে অবশ্য সমৃদ্ধ হয়েছিল বাংলা সাহিত্য। আর সেই সমৃদ্ধির ক্ষেত্র ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর। এখনকার প্রশাসনিক হিসেব নিকেশ করে বললে, ঘাটাল মহকুমায় জন্ম নিয়েছিল মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থটি। কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কাব্য। কাব্য প্রণেতা কবিকঙ্কণ মুকন্দ চক্রবর্তী। কবিকঙ্কণ মুকন্দরাম নাকি রামহীন মুকুন্দ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে পণ্ডিতমহলে। তাঁর সময়কাল নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কিন্তু কবি যে মেদিনীপুর জেলার একটি গ্রামে বসে তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
কিন্তু কী ভাবে মেদিনীপুর পেল মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিকে? উত্তর, রাজনৈতিক অভিবাসন। কবিকঙ্কণের পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। চলে আসেন মেদিনীপুরের আড়রাগড় গ্রামে। কবির মেদিনীপুরে চলে আসার পথ অবশ্য খুব সহজ ছিল না। কোন পথে কবিকে আড়রাগড়ে আসতে হয়েছিল তার অনেকটা বিবরণ পাওয়া যায় প্রণব রায়ের ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ বইয়ে। বনে জঙ্গলে ভরা রাঢ় দেশে জীবনের নিরাপত্তা তেমন ছিল না। পথে বন্যজন্তু, চোর ডাকাতির ভয় তো ছিলই। একদিকে মামুদ শরিফের অত্যাচার। আবার অন্যদিকে মুঘল সেনাদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকিও। মুকুন্দ পরিবার পরিজন নিয়ে মাঠের পথ ধরে এলেন ভালিয়া গ্রামে। এখানেই সেই তেলো-ভেলোর মাঠ। যেখানে সারদাদেবী ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। ভালিয়া গ্রামের পাশেই বয়ে চলেছে মুড়াই নদী। যার নাম এখন মুণ্ডেশ্বরী। কবি নদী বরাবর উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এসে জাহানাবাদের, বর্তমানে আরামবাগ, প্রায় চার কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে দ্বারকেশ্বর নদীর কাছে তেউট্যা গ্রামে পৌঁছে যান।
এর পর দ্বারকেশ্বর নদী পেরিয়ে হাঁটা পথে কবিকঙ্কণ পৌঁছলেন পাতুল গ্রামে। বর্তমানে এটি গোঘাট থানার অধীনে। এখানে থেকে পরাশর, আমোদর এবং নারায়ণ নদী পেরিয়ে পৌঁছন চন্দ্রকোনা থানার অন্তর্গত গুচুড়ে বা গোচড্যা গ্রামে। যার বর্তমান নাম বিষ্ণুদাসপুর। গোচড্যা গ্রামে একটি বৃহৎ জলাশয়ের ধারে কবি বিশ্রাম নেন। এবং এই স্থানেরই বর্ণনা ছিল বিখ্যাত পঙ্ক্তিতে, ‘তৈল বিনা কৈলু স্নান করিলু উদক পান/শিশু কান্দে ওদনের তরে’। এখানেই নিদ্রামগ্ন অবস্থায় দেবী চণ্ডীর আদেশ পান কবি। কবির ভাষায়, ‘করিয়া পরম দয়া দিলা চরণের ছায়া/আজ্ঞা দিলা রচিত সঙ্গীত’। এর পর কবি শিলাই নদী পেরিয়ে যান আড়রাগড়ে।
আড়রাগড়ে আসার পথে ঘাটালের চন্দ্রকোনায় ভান রাজাদের রাজত্ব পেরিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেননি। যেটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ভান রাজারা ছিলেন মুঘল সম্রাটদের অনুগত। তাই তিনি এই রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে অনেকটা দূরে রাজা বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ই উপযুক্ত মনে করেছিলেন। ব্রাহ্মণভূম পরগণার রাজধানী আড়রাগড়। ‘অরাঢ়া’ থেকে আরঢ়া থেকে আড়রা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ এটি রাঢ় দেশের বাইরে। জায়গাটি তখন উৎকল রাজ্যের মধ্যে রাঢ় ও উৎকলের সীমানায়। ব্রাহ্মণভূমের জমিদার বীরমাধবের রাজ্যপাট ছিল আড়রায়। বীরমাধবের পুত্র বাঁকুড়া রায়। কবিকঙ্কণের কাব্যে আছে, ‘আড়রা ব্রাহ্মণভূমি/ব্রাহ্মণ যাহার স্বামী/নরপতি ব্যাসের সমান’।
সেই সময় উৎকল রাজ্যের অন্তর্গত আড়রাগড় একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। রাজা বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় নিরাপদ ভেবেই কবি সম্ভবত এখানে এসেছিলেন। বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন তিনি। রঘুনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেন চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। রাজা রঘুনাথ তাকে কবিকঙ্কণ উপাধি দেন বলে মনে করা হয়। ক্ষুদিরাম দাস সম্পাদিত ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’তে কবির উপাধি সম্পর্কে বলেছেন, ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধি আড়রার রাজাই কবিকে দিয়েছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে একটি পুঁথিতে পালাগায়েনের কথায়, ‘মুকুন্দ রচিত পুঁথি/শুনি সুখে নরপতি/খ্যাতি দিল শ্রীকবিকঙ্কণ’। আড়রাগড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিকে আকৃষ্ট করে থাকবে। কাব্যের অনেক জায়গায় সেই সৌন্দর্যই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিকঙ্কণের মতো ঘাটাল মহকুমার আরেক কবিকেও অত্যাচারিত হয়ে নিজ বাসভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যের কবি রামেশ্বর চক্রবর্তী। কবি রামেশ্বর বরদার রাজা শোভা সিংহের ভাই হিম্মত সিংহের অত্যাচারে ঘাটালের যদুপুর থেকে চলে গিয়েছিলেন কর্ণগড়ের রাজা রাম সিংয়ের আশ্রয়ে। এখানেই তিনি শিবায়ন কাব্য রচনা করেন।
আড়রা গ্রামটি বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর থানার অন্তর্গত। কিন্তু গ্রামে কবিকঙ্কণের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন। আড়রার প্রাসাদ এখন বনেজঙ্গলে ঘেরা ধ্বংসস্তূপ মাত্র। কেমন ছিল বাঁকুড়া রায়ের প্রাসাদ? প্রণব রায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, প্রাসাদের ভিতরে ছিল বিশাল দিঘি। চারপাশে বড় বড় স্নানের ঘাট। দিঘির পাড়ে পাড়ে অট্টালিকা। ভেতর আড়রা আর বাজার আড়রা। এ নিয়ে রাজধানী। গড়ের চারপাশে পরিখা। গড়ের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ঘরবাড়ি বা আস্তাবল ছিল। এখন সেসব কিছুই দেখা যায় না। বর্তমানে একটি বিশাল স্তূপ সেই অট্টালিকার চিহ্ন বহন করছে। ঝোপজঙ্গলে, স্থানে স্থানে বহু মাকড়া পাথরের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। দিঘিটিও রয়েছে। মজে গিয়েছে। পরিখার অস্তিত্বও বোঝা যায়।
গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরে জয়চণ্ডীর মন্দির। শোনা যায়, এখানেই মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গলের পালাগান প্রথম গেয়েছিলেন। মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন চণ্ডীমূর্তি। তাতে একটা প্রমাদ ঘটে গিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন মূর্তিটি বাইরে স্থান পেয়েছে। তার চারিদিক খোলা। সংস্কার হওয়া মন্দিরে কোথাও সন তারিখ নেই। কবির সঙ্গে সংযোগের কোনও তথ্যও নেই। না গড়, না মন্দির, কোথাও নেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের কোনও ব্যবস্থা। ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রকাশ করে এমন কোনও পরিচয়লিপিও নেই। কাছাকাছি এক অঙ্গনওয়াড়ি শুধু কবির নামে। অথচ এই এলাকাই ছিল কবির সৃষ্টিক্ষেত্র। আজ থেকে চারশো সাড়ে চারশো বছর আগে এক ব্রাহ্মণ জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় মঙ্গলকাব্যের একটি ধারাকে পুষ্ট করেছিলেন কবিকঙ্কণ। তাঁর সাহিত্য প্রতিভায় বিস্মিত হন এখনকার পণ্ডিতেরা। অথচ প্রশাসনের কোনও স্তরেই নেই কোনও উদ্যোগ।
আড়রাকে কি কেউ মনে রাখবেন? কবিকঙ্কণকে? কী ভাবে? কতদিন!
লেখক প্রাবন্ধিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy