Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
কবিতা যখন বিদ্রোহ
Faiz Ahmad Faiz

‘‘সেই যন্ত্রণার রাত এখনও ফুরোয়নি, হাঁটা থামিয়ো না’’

জেনারেল, দেখে যান, এত রাতেও এই রেস্তরাঁয় আমরা এই ভাবে আড্ডা মারছি, কবিতা পড়ছি। সাহস থাকে তো দেখে যান!

ফৈজ আহমেদ ফৈজ। ছবি: ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ফৈজ আহমেদ ফৈজ। ছবি: ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৪৫
Share: Save:

জেনারেল, দেখে যান, এত রাতেও এই রেস্তরাঁয় আমরা এই ভাবে আড্ডা মারছি, কবিতা পড়ছি। সাহস থাকে তো দেখে যান!— পাকিস্তানি কবি ফৈজ় আহমেদ ফৈজ়ের (ছবি) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর ‘রিফ্লেকশনস অন এগজ়াইল’ নিবন্ধে এ রকমই লিখেছিলেন এডওয়ার্ড সাইদ।

উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম প্রবক্তা সাইদের সঙ্গে ফৈজ়ের এই আড্ডাটা হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বেরুটে। জেনারেল জিয়াউল হকের নির্দেশে দেশছাড়া হওয়ার পর লেবাননে আশ্রয় নিয়েছিলেন ফৈজ়। সেখানকার প্যালেস্তাইনি কবি, লেখকরাই সেই নির্বাসনে তাঁর বন্ধু।

সত্যিই কি বন্ধু? লেবানিজ় ও পাকিস্তানিদের ধর্মে মিল থাকতে পারে। অনেকেই মুসলমান। কিন্তু ভাষা, কবিতার প্রকরণ, বেড়ে ওঠায় কোনও মিল নেই। সাইদের মনে হয়েছিল, এক দিনই নির্বাসনের এই বিষাদ কাটাতে পেরেছিলেন ফৈজ়। সে দিন পাকিস্তানের আর এক নির্বাসিত কবি ইকবাল আহমেদ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

রাতে দুই কবির সঙ্গে সাইদ গিয়ে বসলেন ছোট্ট এক রেস্তরাঁয়। পানভোজনের মাঝে, সেই রেস্তরাঁর টেবিলে তাঁর কবিতা পড়ে শোনান ফৈজ়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইদের জন্য সেই কবিতাগুলি মুখে মুখে অনুবাদ করে দেন ফৈজ় ও ইকবাল। রাত যত এগোয়, অনুবাদ তত স্তব্ধ হয়ে যায়। বিধ্বস্ত বেরুটের চিলতে রেস্তরাঁয় শুধু গড়িয়ে যায় উর্দু কবিতার ছন্দ। সাইদ লিখেছেন, অনুবাদের দরকারও পড়েনি। দুই কবির কাছে সে রাতে যেন গোটাটাই ছিল বাড়ি ফেরার অনুভূতি। দেশ হারিয়েছে, ঘর হারিয়েছে, কিন্তু দু’জনের কেউই

নতি স্বীকার করবেন না। পাকিস্তানে থাকা সেনাশাসককে যেন বেরুটে বসে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন, দেখে নাও জিয়া, আমরা এখানে। মধ্যরাতের সেই কবিতাপাঠে যতটা বিদ্রোহ, ততটাই নির্বাসনে স্বদেশকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ।

সে রাতে ফৈজ় তাঁর ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন কি না, তা নিয়ে সাইদ কিছু লেখেননি। কানপুর আইআইটি-র শিক্ষক বশীমন্ত শর্মা ও তাঁদের কমিটি খোঁজ নিতে পারেন। কবিতাটি

আদতে হিন্দুবিরোধী কি না, কোন পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীরা সিএএ বিরোধী আন্দোলনে নেমে কবিতাটি পাঠ করেছিল, তা খতিয়ে দেখতেই তো তদন্ত করতে চান তাঁরা।

কবিতার বিরুদ্ধে তদন্ত? ‘একশৃঙ্গ গন্ডার ও নর্তকী’ নামে ফৈজ়ের একটি কবিতা আছে, ‘পাকিস্তানে, এশিয়ার সব দিকে/ আফ্রিকার আনাচেকানাচে/ বর্তমান মানে অতীত/ আর সেই সূদূর অতীতে/ মানুষ, ইতিহাস কেউ রাখেনি মনে/তখন ছিল না সময়, শুধুই সময়হীনতা।’

এই যে সময়হীনতার সংশয়, এটাই তো কবির উত্তরাধিকার। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তে আছে, ‘যা নেই, তা ছিল না। যা আছে তাও ছিল না।’ অতীত মানেই রামরাজত্ব নয়। সময়হীন অতীত আর অস্তিত্বহীনতার কথা বলার জন্য তা হলে ঋগ্বেদের বিরুদ্ধেও তদন্ত কমিটি গড়া হতে পারে!

ঋগ্বেদের কথা আনলাম, কারণ সেটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা। কবিতার নিজস্ব ভাষা, প্রকরণ এবং জাদু থাকে। সেখানে হিন্দুবিরোধী, মুসলিমবিরোধী ইত্যাদি বাতুলতা অর্থহীন। কবিতা স্রেফ দু’রকমের হতে পারে— খারাপ কবিতা ও ভাল কবিতা। আর ফৈজ়ের কবিতা কী রকম, সেটা সাইদ লিখে গিয়েছেন, ‘ইয়েট্স-এর অনুভূতিপ্রবণতা আর পাবলো নেরুদার শক্তিমত্তার মিশ্রণ।’

এই অনুভবের শক্তিমত্তা এসেছিল ঐতিহ্য থেকে। ফৈজ় আহমেদ ফৈজ় মুখ্যত ধ্রুপদী। উর্দু কবিতার প্রচলিত চাঁদ, ফুল, প্রেমের রূপকগুলিকেই তিনি ব্যবহার করেন আধুনিক কবিতার মোড়কে। এই নিবন্ধের জন্য তাঁর বিখ্যাত ‘নাজ্ম’ বা কবিতা ‘মুঝসে পহেলি সি মহব্বত মেরে মেহবুব ন মাঙ্গ’-এর অন্তিম এক স্তবক অনুবাদ করেছেন শ্রীজাত:

শরীরে ফুটেছে অসুখের শত চুল্লি

পুঁজ বেরোচ্ছে গলে যাওয়া ক্ষত উপচে

চোখ ফিরে যায় ওদিকেও, কী বা করব...

আজও রূপে তুমি, কিন্তু বলো, কী করব?

প্রেম নয়, আছে দুনিয়ায় আরও দুঃখ

আছে সে-আরাম, মিলনও যেখানে তুচ্ছ

আগের মতন ভালবাসা, প্রিয়, চেয়ো না

এই যে রূপে অনন্য, কিন্তু আগের মতো ভালবাসা না চাওয়ার অনুরোধ, এই কবিতা ফৈজ় কোনও প্রেম ভেঙে যাওয়ার দুঃখে লেখেননি। লিখেছিলেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ পড়ার পর। চিত্রভাষা একই থাকল, কিন্তু ব্যক্তিগত প্রেমের বাইরেও চলে এল সামাজিক অসুখ, পুঁজ এবং গলে যাওয়া ক্ষতের কথা। বাঙালির মনে পড়তে পারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত লাইন, ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য।’

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতোই ফৈজ় আহমেদ ফৈজ় কমিউনিস্ট কবি। পাকিস্তানের শিয়ালকোট শহরের ১৯১১ সালে জন্ম। ইংরেজি এবং আরবি এই দুই ভাষায় লাহৌর থেকে এমএ করে অমৃতসরে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ত্রিশের দশকে সেখানেই মাহমুদ জাফর, রশিদ জাহানের মতো কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ফৈজ় যোগ দিলেন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স গ্রুপে। এখানেই তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ এক বিখ্যাত উর্দু লেখকের, সাদাত হাসান মান্টো। মান্টো তাঁর থেকে এক বছরের ছোট। আলিগড়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু যক্ষ্মা রোগের কারণে নিয়মিত লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অমৃতসরের কলেজে যখন এলেন, ফৈজ় সেখানে অধ্যাপক। ‘মান্টো খুব একটা পড়াশোনা করত না, সারাদিন দুষ্টুমি করত, কিন্তু আমাকে শ্রদ্ধা করত, উস্তাদ মানত’, এক সাক্ষাৎকারে এক বার বলেছিলেন ফৈজ়। বস্তুত, ফৈজ়ের সম্পাদিত পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল মান্টোর ‘ঠান্ডি গোস্ত’ বা ‘খোল দো’-র মতো গল্প। সেগুলি নিয়েই অশ্লীলতার মামলা। মান্টোর সমর্থনে তখন আদালতে একাধিক বার সাক্ষ্য দিয়েছেন ফৈজ়।

এ সব তো সাহিত্যজীবন। তার আগে, ১৯৪১ সালে গঢ়বাল রাইফেলসের হয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ফৈজ়। কবি যুদ্ধে যাচ্ছেন বলে বাঁকা চোখে তাকানোর কিছু নেই। কাজী নজরুল ইসলাম থেকে উইলফ্রেড আওয়েন, অনেক কবিই প্রথম মহাযুদ্ধে গিয়েছিলেন।

কিন্তু ফৈজ়ের গল্পটা অন্য রকম। ১৯৫১ সালে তাঁকে বন্দি করা হল। অভিযোগ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে দেশে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন ফৈজ় ও তাঁর সঙ্গীরা। কবিরা এই রকমই দুর্বোধ্য প্রহেলিকা। বেঁচে থাকতে পাকিস্তান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে। মরেও শান্তি নেই। কানপুর আইআইটি হিন্দুবিরোধিতার অভিযোগ আনে।

ফৈজ় অবশ্য এ সবে হাসতেন। তাঁর সোজাসাপ্টা কথা ছিল, ‘প্রেমের মতো, জেলখানাও মানুষের জীবনে একটা প্রধান অভিজ্ঞতা। তোমার অস্তিত্বের সামনে অনেক জানালা খুলে দেয় সে।’ জেলখানা নিয়ে ফৈজ়ের এক কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়— ‘শরীর বন্দি, চিন্তাধারায় শিকলের বাঁধন/বিচারধারাগুলো সব বন্দিশালায়/...সাহসের সঙ্গে আমরা তবুও বেঁচে যাই।’ বিদ্রোহ থেকে প্রেম, ঐতিহ্য থেকে নতুনত্ব সব মিলেমিশে গিয়েছে তাঁর কবিতায়।

কবিতার ঐতিহ্য চোখে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না। অধুনাখ্যাত ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতার সেই বিখ্যাত দুই লাইন স্মরণ করা যাক, ‘ব্যস নাম রহেগা আল্লাহকা... উঠেগা আনাল-হক কা নারা’। কট্টরপন্থীদের বক্তব্য, এই আনাল-হক মানে নাকি হিন্দুদের মেরে শরিয়তি আইনের আহ্বান। এঁরা বুঝলেন না, আনাল-হক মানে আমিই পরম সত্য। অহং ব্রহ্মাস্মি। কমিউনিস্ট কবির কবিতায় এত আল্লা, আনাল-হক দেখে কিছু ভারতীয় সেকুলারের ভ্রুও কুঞ্চিত হচ্ছে। এঁরা খেয়াল রাখেন না, সাহিত্যের ভাষা আলাদা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরিতে অনেক জায়গায় মা কালীর কথা আছে, রুশ কবি আন্না আখমাতোভার কবিতাতেও এসেছেন ঈশ্বর। প্রতিটি সংস্কৃতির ভাষাই আলাদা। মানিকের মা আশ্রয়, আর ফৈজ়ের আনাল-হক এক রহস্যময়, বিশাল আব্রাহামীয় ঈশ্বর। সমস্ত অবিচারের অবসান ঘটাতে এই দুনিয়ায় নেমে আসবেন তিনি।

সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার লেনিন শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন ফৈজ়। ষাটের দশকে সাহিত্যের জন্য নোবেল কমিটির মনোনয়ন পেয়েছিলেন, উইকিপিডিয়ার দৌলতে অনেকেই জানেন। কিন্তু উর্দু বিশেষজ্ঞ পুষ্পিতবাবু আর একটি তথ্য জানাচ্ছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এক বার উর্দুতে ইকবাল অধ্যাপকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ফৈজ় রাজি হননি।

এই নারাজ হওয়ার পিছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতেই পারে। যেমন, ভারতে না এসে স্বেচ্ছানির্বাসনে লেবানন যাওয়া। ভারতে আশ্রয় নিলে ফৈজ়ের কবিখ্যাতি স্বদেশে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ত। উপমহাদেশের কবিদের শাপগ্রস্ততা ১৯৪৭ সালে শেষ হয়নি, শুরু হয়েছিল মাত্র। কী ভবিষ্যদৃষ্টি নিয়েই না ‘স্বাধীনতার ভোর’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘শোনো, তোমরা শোনো, সেই যন্ত্রণার রাত এখনও ফুরোয়নি/ হাঁটা থামিয়ো না, দোহাই তোমাদের, হাঁটা থামিয়ো না।’

আজও থামলে চলবে না। ফৈজ়কে মাথায় রেখে এ বার নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলার দিন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy