বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিলেন, সিঙ্গুরে চাষ কমিতেছে। তাঁহার এই মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটি চক্র সম্পূর্ণ হইল। সদ্যসমাপ্ত সাধারণ নির্বাচনে সিঙ্গুরে অধিক ভোট পাইয়াছে বিরোধীরা, হুগলি আসনটি হারাইয়াছে তৃণমূল। চাষিরা শিল্পের দাবিতে মিছিল করিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গ অতঃপর কোন পথে? মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয় বুঝিতে পারিতেছেন, জমি-নীতিতে সংস্কারের প্রশ্নটি ফের রাজ্য-রাজনীতির কেন্দ্রে আনিতে হইবে। ইদানীং এই রাজ্যের রাজনীতি-চর্চার একমাত্র অর্থ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, নেতাদের দলবদলের হিসাব। দলীয় রাজনীতির উত্তেজনা শাসক ও বিরোধী, উভয়ের নিকট হয়তো স্বস্তিকর। রাজনীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও দলসর্বস্ব হইলে অর্থনীতি ও প্রশাসনের নীতির আলোচনাকে সরাইয়া রাখাও সহজ হয়। কিন্তু রাজ্যবাসী ভোলেন নাই, ২০১১ সালে এ রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতায় যে পরিবর্তন আসিয়াছিল, তাহার মূলে ছিল একটি নীতিগত প্রশ্ন। কৃষিজমির উপর চাষির স্বাধিকার, এবং ভূমিহীন চাষির রোজগারের সুরক্ষার প্রশ্ন। বামফ্রন্টের শিল্পনীতি এই দুইটিকেই বিপন্ন করিতেছে, এই আশঙ্কা দেখা দিয়াছিল। মমতা বিরোধী নেত্রী হিসাবে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফিরাইয়া দিবেন। ক্ষমতায় আসিয়া সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করিয়াছেন। কৃষির জয় বুঝাইতে নিজহস্তে সিঙ্গুরের জমিতে সরষের বীজ ছড়াইয়াছিলেন। কিন্তু তাহার ফল কী ফলিল? আজ তাঁহাকেও এই সত্য স্বীকার করিতে হইতেছে যে, চাষির চাষ করিবার উৎসাহ কমিতেছে, অনেকেই জমি বিক্রয় করিতেছেন। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, সরকার চাষিকে জমি ফিরাইয়া দিতে পারে, চাষে সহায়তা করিতে পারে, কিন্তু চাষ করিতে জোর করিতে পারে না।
এই বক্তব্যটিকে লইয়া প্রশ্ন উঠিবে। সত্যই কি সিঙ্গুরের, তথা এই রাজ্যের চাষির প্রতি সরকারের কর্তব্যটি কৃষিজমির সুরক্ষা এবং চাষে সরকারি সহায়তাদানেই সমাপ্ত হইয়া যায়? ঘটনা হইল, জমিই চাষির প্রধান সম্পদ। চাষ যখন যথেষ্ট লাভজনক হইতে পারে না, তখন জমিকে অর্থসম্পদে পরিণত করিয়া, সেই পুঁজি কাজে লাগাইয়া অন্য পেশায় সরিয়া যাইবার ঝোঁক সারা দেশেই দেখা দিয়াছে। বিশেষত ২০১৩ সালে কেন্দ্র জমি অধিগ্রহণের যে আইন আনিয়াছে, তাহাতে সরকারের দ্বারা জমির অধিগ্রহণ কৃষকের নিকট অত্যন্ত আকর্ষক হইয়া উঠিতেছে। ২০০৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার যে দরে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ করিয়াছিল, কেন্দ্রের নূতন আইন অনুসারে আজ চাষি পাইতে পারেন তাহার আট হইতে দশগুণ টাকা। অতএব সরকারের দ্বারা জমি অধিগ্রহণ চাষির নিকট আজ আর আশঙ্কা নহে। তাহার আশায় বহু চাষি দিন গনিতেছেন। আক্ষেপ এখানেই, মমতা তাঁহার আট বৎসরের শাসনকালে জমি অধিগ্রহণের আইন নূতন করিয়া প্রণয়ন করেন নাই। মাথা কাটিয়া মাথাব্যথা সারাইবার মতো, জমি অধিগ্রহণ কার্যত বন্ধ করিয়া তিনি জমি বিক্ষোভের সমাধান করিতে চাহিয়াছেন। চাষি খুশি হইবেন কেন?
সরকার জোর করিয়া চাষ করাইতে পারে না। কিন্তু সরকার তাহার কর্তব্য এড়াইতেছে বলিয়া চাষি যদি চাষ করিতে বাধ্য হন, অথবা কৃষিজমি অনাবাদী ফেলিয়া রাখেন, সরকার সেই দায়ও এড়াইতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে কৃষির ভবিষ্যৎ লইয়া স্বচ্ছ, সাহসী আলোচনার প্রয়োজন। তৃণমূল সরকার চাষির সহায়তায় কী কী করিয়াছে, তাহার তালিকা দীর্ঘ হইতে পারে। কিন্তু সর্বভারতীয় তথ্য অনুসারে এ রাজ্যে চাষির বার্ষিক রোজগার এক লক্ষ টাকাও নহে। অতি-খণ্ডিত জমি, অতি দুর্বল বিপণন পরিকাঠামো চাষিকে বিপন্ন করিতেছে। ইহার প্রতিকারে নীতির বড় মাপের সংস্কার প্রয়োজন। জমি ফিরিয়া পাইয়াও কেন চাষি মুখ ফিরাইলেন, সেই জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি না দাঁড়াইয়া নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গত্যন্তর নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy