প্লাস্টিকের প্যাকেট আটকে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক উজলি (হোয়াইট স্টর্ক)। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সৌজন্যে ছবিটা হুহু করে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। দক্ষিণ স্পেনের একটি সৈকতে ছবিটি তুলেছিলেন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার জন কানকালোসি। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্যপদার্থে ভর্তি দুর্গন্ধময় স্পেনের এই সৈকতটি দেখে বেজায় অবাক হয়েছিলেন তিনি। বিপন্ন পাখিটির ছবি তোলার পর জন প্যাকেটমুক্ত করেছিলেন তাকে। প্লাস্টিকের বন্ধন থেকে ছাড়া পেয়ে সে নিমেষে নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল। চোখ মেলে দেখেছিলেন আলোকচিত্রী, যত ক্ষণ তাকে দেখা যায়।
প্রথম বিশ্বের এই রকম একটা ছবির পাশে তৃতীয় বিশ্বের একটা ছবি রাখা যাক। ছোট্ট দেশ ভুটান। মধ্য ভুটানের প্রত্যন্ত অঞ্চল ফোবজিখা উপত্যকা। এই তো কয়েক বছর আগেও বিদ্যুৎ ছিল না সেখানে। কারণ? ও দেশের সরকার চাইত না, তাই! এই না-চাওয়ার পিছনে কারণটা হল, বিদ্যুতের খুঁটির তারে আটকে পড়ে মারা যেতে পারে তিব্বত থেকে আসা কালো গলার সারসের (ব্ল্যাক নেকড ক্রেন) দল। এরা অক্টোবরের শেষে তিব্বত থেকে ভুটানের এই উপত্যকায় চলে আসে। দলে দলে। ফিরে যায় ফেব্রুয়ারির শেষে। এই ক’টা মাসের জন্য, কয়েকটা পরিযায়ী পাখির স্বার্থ দেখতে গিয়ে পুরো একটা অঞ্চল অন্ধকারে থাকবে, এমনটাই জানিয়েছিল দেশের সরকার। না, এর জন্য বিদ্রোহ হয়নি।
১৯৮৭ সালে তৈরি হয় ভুটানের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়্যাল সোসাইটি ফর প্রোটেকশন অব নেচার (আরএসপিএন)। এদের অফিস রাজধানী থিম্পুতে। এদের সঙ্গে রাজা প্রজা মন্ত্রী আমলা বুড়ো জোয়ান এক সঙ্গে কোমর বেঁধে নামেন দেশের পরিবেশকে আগলে রাখতে। একটা কার্বনমুক্ত দেশ তৈরি করার চেষ্টায়। ফোবজিখা পরিযায়ী সারসদের কথা তৎকালীন রাজার কানে যেতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সারসরা যেন এখানে উপযুক্ত পরিবেশ পায়। তাদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। ১৯৯৯ সালে এই পরিযায়ী সারসদের সংরক্ষণের কথা ভেবে আরএসপিএন-এর আরও একটা অফিস তৈরি হয় ফোবজিখায়। এর আগের বছর ১১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় বার্ষিক ব্ল্যাক নেকড ক্রেন উৎসব। প্রতি বছর এই দিনে সারসের মুখোশ পরে নাচ, লোকগান, নাটকে জমজমাট এই উৎসবের একটাই বিষয় ব্ল্যাক নেকড ক্রেন। স্থানীয় মানুষ থেকে স্কুলের ছেলে-মেয়ে, সকলেই যোগ দেয় পারফরম্যান্সে। আরএসপিএন বুঝতে পেরেছিল, গ্রামবাসীদের সাহায্য ছাড়া এই কাজ তারা করতে পারবে না। তাই প্রথম থেকেই গ্রামের মানুষদের ওই সারসদের সম্পর্কে শিক্ষিত করতে শুরু করে সংস্থা। যে কাজ থেমে নেই।
বিদ্যুৎ না থাকায় আপনাদের কোনও সমস্যা হয় না? কয়েক বছর আগে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ফোবজিখার এক গ্রামবাসী বলেছিলেন, ‘‘বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু বিদ্যুৎ ছাড়াও আমরা থাকতে পারব। বিদ্যুৎ থাকলে সারসরা অনেক দূরে চলে যাবে। আমাদের খুব ভাল লাগে যখন ওরা আসে। সেই ছোট থেকে দেখছি তো।’’ এই চেতনা কি প্রথম বিশ্বের নাগরিকদের আছে? ওই ছোট্ট গ্রামটির মানুষ কয়েকটি পাখির জন্য অন্ধকারে থাকাকে, উন্নত প্রযুক্তির কাছ থেকে দূরে থাকাকে মেনে নিয়েছিলেন।
আজ অবশ্য বিদ্যুৎ আছে ফোবজিখার প্রতিটি ঘরে। সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুতের সমস্ত তার গিয়েছে মাটির তলা দিয়ে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারসদের জন্য বিস্তৃত চারণভূমিতে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। নিয়ন্ত্রণ করা হয় কুকুর ও গৃহপালিত পশুদেরও। এই জন্যই ফোবজিখায় ঢুকতেই গাড়ির চালক সচেতন করে দেন পর্যটকদের এই বিষয়ে। লক্ষ্মণরেখা যেন পার না করি। তা হলে শাস্তি অনিবার্য। ফোবজিখার পাশের গ্রাম গ্যাংতেং। এই গ্রামের মানুষও সদা সচেতন। সারসরা তো সীমারেখা বোঝে না। গ্যাংতেং-এর প্রাচীন বৌদ্ধমঠের চাতালেই তো হয় ওই বার্ষিক উৎসব। গত বছর ফোবজিখার গ্রামবাসীরা উদ্ধার করে এক আহত সারসকে। চিকিৎসার পর এখন সে সুস্থ হওয়ার পথে। তার দেখভালের দায়িত্ব সংস্থার। তার একটা নামও দিয়েছে তারা— কার্মা (অর্থাৎ কর্ম)। এ বছর কার্মা হয়তো উড়ে যাবে তার বন্ধুদের সঙ্গে।
এই পরিযায়ী সারসদের আসা শুরু হলে পর্যটকের ভিড় বাড়ে দুই গ্রামে। সারসদের চারণভূমি থেকে আরএসপিএন-এর অফিস অনেকটা দূরেই। সেই অফিসের কাচের জানালা দিয়ে দূরবিনে চোখ লাগিয়ে দেখা যায় সারসদের উড়ান। পাওয়া যায় ব্ল্যাক নেকড-এর ছাপওয়ালা নানান সুভেনির। পাওয়া যায় এই সারস সম্পর্কে সব রকমের তথ্য। ফোবজিখার মানুষদের সঙ্গে এই পরিযায়ী সারসদের সম্পর্ক নিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে ভারতীয় হিসেবে লজ্জাই লাগছিল। কারণ ওই মরসুমে তিব্বত থেকে এই সারস উড়ে যায় লাদাখে। কিন্তু তাদের কথা কেউ ভাবলে তো? কুকুর, ঘোড়া আর ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের একাংশের দৌরাত্ম্যে ক্রমশ কমে আসছে এই পরিযায়ীদের আসার সংখ্যা।
বিশ্বের প্রথম কার্বনমুক্ত দেশ হতে পেরেছে ভুটান। কাঁধ পেতে নিয়েছে ভারত ও চিনের প্রতিনিয়ত দূষণের দায়ভার। ভুটানের প্রাক্তন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক বেশ কিছু আইন করেছেন পরিবেশের পক্ষে। যেমন, কাঠ রফতানি বন্ধ করা হয়েছে। দেশের মধ্যেও জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করতে গেলে সরকারি অনুমতিপত্র লাগবে। ভুটানের মোট জঙ্গলের ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। সেখানে এমন ভাবে রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যাতে পশুপাখি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে।
আরও একটা বিশ্ব পরিবেশ দিবস এল এবং চলে গেল। সমীক্ষা বলছে, বছরে ৯০ লক্ষ (৯ মিলিয়ন) টন প্লাস্টিক বর্জ্যপদার্থ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে বিশ্ব। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কেটে সাফ করে ফেলা হচ্ছে অরণ্য। ভুটানে কিন্তু উন্নয়ন ও পরিবেশ গলা জড়াজড়ি করেই আছে। সন্দেহ নেই, পুঁচকে দেশটার কাছে আমরা গোহারান হেরে গিয়েছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy