ছবি: সংগৃহীত
রামজন্মভূমি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘিরে নানা পরিসরে তর্কবিতর্ক যতই চলুক, ভারতে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে কোথাও কোনও অশান্তি বাধেনি। এটা ভারতের গণতন্ত্রের একটা উজ্জ্বল সাফল্য। তাকে ধরে রাখতে হলে, সবারই খানিকটা সতর্ক থাকা দরকার। এই মামলা কোনও খেলা ছিল না, তাই রায়টাও কোনও স্কোরকার্ড নয়, যা দিয়ে জেতা-হারার নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু মুশকিল হল, সুপ্রিম কোর্টের রায়ও যদি তথাকথিত লিবারালদের একাংশের বিচারধারা থেকে ভিন্ন কথা বলে, আপনাকে তার বিরোধিতা করতে হবে, নইলে আপনি প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু ‘ভিন্নমত’-এর স্পেসটা নিকেশ করে ‘ভিন্নমত’-এর এই চর্চা চিনে প্রযোজ্য, ভারতে নয়। বিচারপতিরা আমার অপছন্দের সরকারকে তুলোধোনা করলে উল্লাস করব, আর রায় পছন্দের বাইরে গেলেই সর্বোচ্চ আদালতের ‘সততা’ নিয়েও ঘুরিয়ে প্রশ্ন তুলব, এই দ্বিচারিতা এলিটদের, সাধারণ মানুষের নয়। রায় ঘোষণার পরের তিন দিনে দেশের দু’প্রান্তের দু’টি প্রত্যন্ত গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ঠিক ততটাই ঘন হয়ে বসে চা খেতে দেখেছি, এক বছর আগেও যেমন দেখেছিলাম।
ভারতের জনসাধারণ জানেন, আধ্যাত্মিকতা এই দেশের শক্তিই শুধু নয়, সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। গজদন্তমিনারবাসী ক’জন তাত্ত্বিক খোঁজ রাখেন যে ভারতের প্রায় প্রতিটা বড় বড় মন্দিরে সব সময় কয়েক জন মুসলমান বাস করেন? মন্দিরের ভেতর মুসলমান? আজ্ঞে, হ্যাঁ। কারণ, যে কোনও বড় মন্দিরে কোনও না কোনও নির্মাণ কিংবা সারাইয়ের কাজ চলতেই থাকে। আর তা করেন রাজমিস্ত্রিরা, যাঁরা অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এক বার একটি আশ্রমে চপ্পল পায়ে পঞ্চবটীর দিকে যেতে গিয়ে এক রাজমিস্ত্রির কড়া ধমক খেয়েছিলাম। সেই মানুষটার আত্মায় যে পাঁচ হাজার বছরের ভারতবর্ষ জেগে রয়েছে, তা জানতে না দেওয়াও স্বৈরাচার।
শুধু ভারত নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই রাম কিংবা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা হিন্দুদের একচেটিয়া নয়। সম্প্রতি অনিতা বসুর দীর্ঘ গবেষণার ফসল রামায়ণ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পদচিহ্ন বইটির প্রতি পাতায় সেই সত্যকেই যেন নতুন ভাবে দেখতে পেলাম। তাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়ার শহরে-গ্রামে আজও প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় রামকথা হয়, রামায়ণকে কেন্দ্র করে চলে নাচ-নাটক-শিল্পের কার্নিভাল। কত শিল্পী রামায়ণের চরিত্রদের পোশাক, মুখোশ বানিয়ে সসম্মান বেঁচে আছেন, কত হাজার মানুষ পথ চেয়ে থাকেন বার্ষিক ‘আন্তর্জাতিক রামায়ণ উৎসব’-এর দিকে, যেখানে বহু দেশের শিল্পীরা রামায়ণের এক-একটি অংশ অভিনয় করেন! দক্ষিণ ভারতের বেলারি জেলার কিষ্কিন্ধ্যার বাসিন্দা হনুমান যে সমগ্র উত্তর ভারতের পাশাপাশি ফিলিপিন্স লাওস কাম্বোডিয়া ইন্দোনেশিয়াতেও তুমুল জনপ্রিয়, তা একটি নিবিড় সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথা বলে না? মালয়েশিয়ার প্রায়-তালিবানি শাসনব্যবস্থা অবশ্য রামায়ণকে প্রায় নিষিদ্ধ করেছে, আর তার ফলে রামায়ণের পুতুল আর পোশাক বানিয়ে বেঁচে থাকা হাজারো শিল্পীকে অনাহারের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু সেই আবহেই মনে পড়ে গেল মালয়েশিয়ার এক বালিকার কথা, যে কর্কশ নির্দেশের মুখে দাঁড়িয়েও রামের মূর্তি মাটিতে নামিয়ে রাখতে অস্বীকার করেছিল, দু’হাত দিয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, কাথিয়াবাড় থেকে বিহার, হিমালয় থেকে বিন্ধ্য, হাজার বছরের মন্দির ধ্বংসের ইতিকথা। উত্তর ভারতে সুপ্রাচীন মন্দিরের অপ্রতুলতা তাঁর কথার সত্যতা প্রমাণ করে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর কনৈলা কী কথায় ভারতীয় জনসমাজের উপর সুলতানি আমলের নারকীয় অত্যাচারের কথা লিখেছেন। নীরদচন্দ্র ‘ভক্ত’ ছিলেন না, আর রাহুলকে ‘সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল’ বলার স্পর্ধা দেখাবেন কি কেউ? মোদ্দা কথা, একটি জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করাই সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িকতা। সেই জনগোষ্ঠী জার্মানির ইহুদি, প্যালেস্তাইনের মুসলমান না পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু, তাতে কিছু আসে যায় না। অত্যাচার হলেই প্রতিবাদ। প্রতিবাদ মানে কিন্তু প্রতিশোধ নয়। ও দিকের দাঁড়িপাল্লায় অনেক ‘ধ্বংস’, আমার দাঁড়িপাল্লায় ‘কম’, তাই আমি ধ্বংস দিয়ে ধ্বংসের প্রতিবিধান করব, এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না।
যুক্তি আছে বলেই পুরাতাত্ত্বিক কে কে মহম্মদের বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রত্নতত্ত্বের প্রমাণের সামনে দাঁড়িয়ে ভারত-ইতিহাসের নিয়ন্তাদেরও থমকাতে হয়েছে। এখন, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলছেন যে বাবরি মসজিদের নীচে তৃতীয় স্তরে যে মন্দিরটি পাওয়া যাচ্ছে, সেটি একটি শৈব মন্দির। রাম সে সময় দেবতা হিসেবে তত পরিচিতই ছিলেন না। অবিভক্ত ভারতবর্ষ জুড়ে শৈব ভাবধারার প্রভাবই ছিল প্রধান। রামের জনপ্রিয়তা শুরু হয় কবি তুলসীদাসের রামচরিতমানস প্রকাশের পর। এটা অর্ধসত্য। মিনিয়াপোলিসের একটি ঘরোয়া সেমিনারে নানা দেশের গবেষক-চিন্তকদের এ বিষয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। সেই সভায় উপস্থিত থাকার সুবাদে ও বেশ কিছু দিন কাশীবাসের সূত্রে মনে হয়, শিব বা কৃষ্ণের বদলে রামের ভারতের প্রধান দেবতা হয়ে ওঠার পিছনে তুলসীদাসের কৃতিত্ব কিছুটা হলেও পুরোটা নয়। এর পিছনে আছে শত শত বছরের রাজনীতি, যা এমন ভাবে চেপে রেখেছেন বোম্বাগড়ের ইতিহাসবিদরা যে ‘ওরাল হিস্ট্রি’ ছাড়া সত্যের কাছাকাছি পৌঁছবার অন্য রাস্তা নেই।
রামের অতি বড় ভক্তও মানবেন, দেবতা হিসেবে কৃষ্ণ বা শিব অনেক বেশি ক্যারিশম্যাটিক। কাশীর এক ভিক্ষুক সেই গল্প শুনিয়েছিলেন যেখানে গঙ্গাকে জটায় ধারণ করেছিলেন শিব, আর সতী তাতে কষ্ট পাওয়ায় তিনি সতীকে শরীরে ধারণ করে হয়ে উঠলেন অর্ধনারীশ্বর। সেই ভিক্ষুকের কোনও পিএইচ ডি ছিল না, কিন্তু তিনিও বুঝতেন, এমন দেবতার শিরেই প্রবল ভালবাসায় জল ঢালতে চাইবে মেয়েরা। প্রায় হাজার বছর পিছিয়ে দ্বাদশ শতাব্দীতে চলে গেলে দেখব, কন্নড় শৈব কবি মহাদেবী আক্কা লিখছেন, “মানুষ/ পুরুষ হোক বা নারী/ লজ্জা পায় যখন লজ্জাবস্ত্র আলগা হয়ে যায়/ ...যখন সারা পৃথিবীই প্রভুর চোখ/ আর তাঁর দৃষ্টি সর্বত্র/ কী ঢাকবে তুমি, কীই বা লুকোবে?” নগ্নতাকেও সেলিব্রেট করার এ অধিকার শৈবসংস্কৃতিই দিয়েছিল মেয়েদের।
এ বার পুরুষের ক্ষমতা রূপান্তরিত হয় আস্ফালনে, মেয়েদের ক্ষমতা রূপ পায় উৎসবে। চণ্ডী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের নিয়ন্ত্রক শক্তি হলেও তাঁদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ে বিঘ্ন ঘটে না। জন্মাষ্টমী, শিবরাত্রি কার্নিভালের রূপ পায়, অজস্র নারীর মাখনের হাঁড়ি ভাঙার বা শিবকে স্নান করানোর উল্লাসে।
যত বার সোমনাথ বা বিশ্বনাথ মন্দির আক্রান্ত হয়েছে, মেয়েরা ঘরে ঢুকে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আর মায়েরা ঘরে ঢুকে গেলে মায়ের হাত-ছাড়ানো ছেলেগুলো রুক্ষ হয়ে ওঠে। এবং এমন পার্বণ কেন্দ্রস্থলে আসে যেখানে নারীর ভূমিকা কম, বিজয়া দশমী থেকে সিঁদুরখেলা সরে যাওয়ার মতো করে রং আর মাধুর্য সরে যেতে থাকে, বাড়িতে বাড়িতে জন্ম নেয় উঠোন, যাতে চৌহদ্দির ভেতরে থেকে আকাশ দেখতে পারে মেয়েরা, আর বাইরের পুরুষ পৃথিবীতে অস্ত্রের ঝনঝনানি দাবি করতে থাকে বিকল্প অস্ত্র। এক সন্তাপের সেলিব্রেশান শুরু হয় তপ্ত হাওয়ায়, যত ক্ষণ না কোনও অহল্যাবাই হোলকার অসংখ্য ধ্বংসস্তূপকে ফিরিয়ে দেন দেবালয়ের অবয়ব, শক্তি যে ভাবে বার বার শিবকে শ্মশান থেকে টেনে আনেন সংসারে। রাম নিজেও শিব-শক্তির লীলা উপলব্ধি করতেন। নইলে রাবণ শিবের ভক্ত জেনেও তিনি মা দুর্গার অকালবোধন করার সাহস পাবেন কী করে?
সরযূর তীরে দাঁড়িয়ে আজও কোনও রাতে, হয়তো বা, জনতা-জনার্দনের অসংবেদনশীলতায় নিজের প্রাণপ্রিয়াকে ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করা গণতান্ত্রিক রাম, আজীবন রাজা আর চিরকালের উদ্বাস্তু রাম, সঙ্গে করে বনবাসে না নিয়ে যেতে চাওয়ায় সীতার মুখে ‘পুরুষের আকৃতিবিশিষ্ট স্ত্রীলোক’-এর তকমা পাওয়া রাম, (“কিং ত্বামন্যত বৈদেহঃ পিতা মে মিথিলাধিপ/ রামং জামাতরং প্রাপ্য স্ত্রিয়ং পুরুষবিগ্রহম্), ভবভূতির ভাষায়, বজ্রাদপি কঠোর এবং কুসুমের মতো কোমল রাম, গুনগুন করে ওঠেন, “তারে দেখাতে পারিনে কেন প্রাণ খুলে গো/ বোঝাতে পারিনে হৃদয় বেদনা”, তাঁর চোখের জলে জেগে থাকে সেই শৈবসংস্কৃতিরই কল্পনা যেখানে পুরুষের থেকে নারীকে, বৃষ্টির থেকে মাটিকে আলাদা করা যায় না।
তখনই হয়তো রঘুপতি রাঘবের সামনে এসে দাঁড়ায় সেই মালয় মেয়েটি যে শত হুমকিতেও তাঁর মূর্তি মাটিতে রাখতে সম্মত হয়নি। নরচন্দ্রমা রামকে সে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় তোমার মন্দির?” মর্যাদা পুরুষোত্তম সেই বালিকার মুখশ্রীতে নিজের জন্ম-না-নেওয়া কন্যাকে আবিষ্কার করেন। আর তার পর তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেন, “তোমার দুটো হাতের আশ্রয়ে, তোমার দুটো হাতের আশ্রয়ে, তোমারই দুই হাতের আশ্রয়ে।”
ঋণ: লাইফ অব আ টেক্সট, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া প্রেস, ১৯৯১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy