স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন। ছবি: পিটিআই
স্বাধীনতা কাহাকে বলে, সেই যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনায় বসিবার অবকাশ ক্রমশই সীমিত হইয়া আসিতেছে এই ভারতবর্ষে। বরাবরই ভারতবাসী স্বাধীনতার ধারণাটিকে মালায়, পতাকায়, সঙ্গীতে এমন আবৃত করিয়া রাখে যে পুষ্পশোভিত মানচিত্রের মধ্যে কোথাও যে দেশের মানুষও রহিয়া গিয়াছে, তাহা প্রায়শ দৃষ্টিগোচর হয় না। লালকেল্লায় যখন ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা সগর্বে আকাশের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দেয়, অথবা সেনাবাহিনীর সদম্ভ পদধ্বনিতে যখন রাজপথ মুখরিত হয়, আমরা শিহরিত হইয়া উঠি, আর শিহরনের প্রচ্ছন্নতায় আশঙ্কিত হইয়া ভাবি এই স্বাধীনতা পালনের জন্যই কি মধ্যরাতে নিয়তির সহিত গাঁটছড়া বাঁধিবার কথা বলিয়াছিলেন জওহরলাল নেহরু, স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পরাধীন দেশের আত্মত্যাগী আজীবন সংগ্রামী নেতা? ভাবি, স্বাধীনতার প্রসারিত অঙ্গন শুধু কি আড়ম্বরের শিহরনের অপেক্ষাতেই থাকে? না কি তাহার আর্তি ‘স্বাধীন’ নাগরিকের জন্য? নাগরিকের জীবন, ভাষা, সংস্কৃতি এবং মত প্রকাশের অধিকারের প্রতিষ্ঠাই কি স্বাধীনতাকে সার্থক করিতে পারে না? আজিকার ভারতবর্ষে এই আর্তি ভয়ানক হইয়া উঠিয়াছে, স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের সামনে এই সকল প্রশ্ন নীরব ভর্ৎসনায় যেন বধির করিয়া দিবার উপক্রম করিতেছে।
বাস্তবিক, সত্তরোর্ধ্ব ১৫ অগস্ট যে বিপুল তরণী লইয়া কালের ঘাট অতিক্রম করিয়া ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হইতেছে, সুদক্ষ কান্ডারির অভাব তাহার কখনওই হয় নাই। মহাত্মা গাঁধীর ‘স্বরাজ’ ভাবনাই হউক, অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশ’ চেতনা, দেশবন্ধুর ত্যাগের আহ্বানই হউক, অথবা নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ-এর স্বপ্ন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কিংবা খান আবদুল গফফর খানের আজীবন স্বাধীনতার সাধনা, বার বারই ধ্বনিত হইয়াছে দেশের নামে মানুষের জয়গান, বিভিন্ন মত ও পথের স্বীকৃতি। আজ উত্তরাধিকার সূত্রে যে সীমান্ত রক্ষা করিবার গৌরব আমাদের মহিমান্বিত করিয়াছে, তাহা অর্জন করিবার ইতিহাসও বিস্মৃত হইলে চলিবে না। এই ইতিহাস অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের, যাঁহারা ভিন্ন ভিন্ন পথে স্বাধীন একটি দেশে স্বাধীন জীবনযাপনে পৌঁছাইবার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। কেবল পতাকা উত্তোলন আর সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ নহে, পরাক্রান্ত বিভেদবিলাসী নেতার স্পর্ধিত আত্মপ্রচার নহে— তাঁহাদের স্বপ্নের স্বাধীনতার উদ্যাপিত হওয়ার কথা ছিল অতি বিচিত্র অতি সমৃদ্ধ ভারতীয় গণদেবতার আরাধনায়।
দুর্ভাগ্য, আজ এই দেবতাকে আমরা কালের গহ্বর হইতে টানিয়া স্বর্ণশোভিত বিতংসে বন্দি করিতে উদ্যত৷ তাঁহার বিপুলতা এবং বৈচিত্রকে অদ্যকার দীন যোগীগণ উপলব্ধি করিতেই সক্ষম নহেন। তাঁহাদের ক্যানভাসে রঙের সংখ্যা সীমিত। সেই রঙে দেশমাতৃকার বিপুল বৈচিত্রকে তাঁহারা ধরিতে অক্ষম। ‘বহু’কে মারিয়া ‘এক’ করিবার অপচেষ্টা শেষকালে বৈচিত্রকে হারাইয়া থাকে, একতাকেও সুরক্ষিত রাখিতে পারে না। অতিমারির ভয়ঙ্কর আবহেও নির্বাচনের ঘুঁটি ক্রমশ সক্রিয় হইয়া উঠে। আশঙ্কা জাগে, সমাধিস্থল হইতে ‘বিদেশি’ প্রেতাত্মা পুনর্বার উঠিয়া আসিয়া পাছে নিরীহ সাধারণ নাগরিকের প্রপিতামহীর মাতৃপরিচয়ের শংসাপত্র দাবি করিয়া বসে। আমাদের দুর্ভাগ্য, যুক্তিহীন সেই উন্মাদনার গতিপথ আজ রুখিয়া দাঁড়াইবার কেহ নাই। মেধাবী ভারত এখন আর রাজনীতির পঙ্কিল পথে পা রাখিবার উৎসাহ পান না। এমনকি দেশের মেধাঙ্গনেও বিচরণ করিবার উৎসাহ তাঁহারা হারাইয়া ফেলিতেছেন, কেননা সত্যকারের মেধা ও বোধ তাহার চর্চার জন্য স্বাধীনতা দাবি করে। সৎ ও সেবাব্রতী নাগরিকরা নিজেদের হারাইয়া ফেলিতেছেন, কেননা শাসকের জয়ধ্বনিতে যে দেশ প্রাত্যহিক মনোনিবেশ করিয়া থাকে— তেমন দেশের স্বপ্ন তাঁহারা দেখেন নাই। তাঁহাদের স্বপ্নে ছিল এমন এক দেশ যেখানে ক্ষুধা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, বৈষম্যে জনগণের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাইবে না; প্রতিটি উষালগ্ন নাগরিকের কাছে একটি সার্থক দিবসের অভ্যর্থনা হইয়া উঠিবে। অনেক বিভেদ বিসংবাদের মূল্য চুকাইয়া এই দেশ লাভ করিতে হইয়াছে, আর নূতন করিয়া সেই ভেদাভেদের কালসাগরে ডুবিতে হইবে না। এমন এক প্রতীক্ষাতেই রহিয়াছেন ভারতীয় নাগরিকরা, ভারতের জনগণ-মন। মনে হয় যেন, তাঁহাদের ঠিক পাশেই, উন্মুখ অসহায়তায়, মলিন বিধুর মুখখানি লইয়া সেই অনাস্বাদিত ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমাণ আর এক জন: ‘স্বাধীনতা’ নিজেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy