ফাইল চিত্র।
ছাত্রবয়স থেকেই শুনে এসেছি, অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা বা প্রধান কাজ। এই গুরুবাক্য শুনে শুনে কখন যে বড় হয়ে গিয়েছি, খেয়ালই হয়নি। পড়াশোনায় খুব একটা উল্লেখ করার মতো কিছু না করতে পারলেও সুস্থ ভাবে গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা হয়তো করে উঠতে পেরেছি।
সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সংস্কৃতের ক্লাসে মাস্টারমশাই যে শ্লোকটার উপর গুরুত্ব দিতেন, তার মর্মার্থ হল, বিদ্যা বিনয় দান করে, বিনয়ী হলে বন্ধুবান্ধব হয়, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আসে ধন-মান-যশ এবং ধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে বাঁচা ধন-মান-যশের চেয়েও বেশি সুখপ্রদায়ী। এত বছর পরেও আর কিছু মনে রাখি বা না রাখি এটুকু অন্তত মনে রাখতে পেরেছিলাম যে, বিদ্যা বিনয় দেয়।
কিন্তু বর্তমানে তথাকথিত আধুনিকতার প্রভাবে একটা বিষয় ভীষণ ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক হারে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে কোনও রকম স্থান, কাল, পাত্র ভেদ থাকছে না। তা সে শহরই হোক বা গ্রামেরই হোক। উত্তরবঙ্গের এক গ্রামীণ এলাকার এক হাইস্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে দেখেছি, কী ভাবে দিনের পর দিন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নৈতিক মানের অবনমন ঘটে চলেছে। এই সমস্যা এক গভীরতর সামাজিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। সব পড়ুয়াই যে এই অবনমনের শিকার, তা মোটেও নয়। কিন্তু বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী এর শিকার তো অবশ্যই। যা একই সঙ্গে তাদের নিজেদের শিক্ষা এবং বন্ধুবান্ধবের শিক্ষাকেও ব্যাহত করছে। এটা মোটেই কাম্য ছিল না।
একটি শিশুর প্রাথমিক ভাবে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার গুণাবলি তার পরিবারের মাধ্যমেই শুরু হয়। পরিবারের, বিশেষ করে মায়ের কাছ থেকেই সে প্রাপ্ত হয় বিশেষ নৈতিক শিক্ষা। আর তার পরে তাকে শিক্ষা দেয় সামাজিক পরিবেশ এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। একজন প্রকৃত শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত ভাবে সেই সব শিক্ষা দেন, যা তাকে মূল্যবোধ তৈরি করতে সহায়তা করে। সমস্যা এখন এটাই যে, আধুনিক শিক্ষার মাপকাঠিতে বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার আলাদা করে কোন ক্লাস হয় না। যা একান্ত ভাবে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। নৈতিকতার অবক্ষয় সারা ভারতের মতোই উত্তরবঙ্গের শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না কোনও মতেই। এবং তা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে প্রান্তিক গ্রামীণ এলাকায়। শিক্ষকেরা বিষয়ভিত্তিক পড়ানোর সময় নিজেদের মতো করে নৈতিক শিক্ষা পড়ুয়াদের প্রদান করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তা গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ ভাবে সেই পড়ুয়াদের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।
পাঠ্যপুস্তকের পাতায় সংবিধানের কর্তব্য লিখে প্রচার করলেই দায়িত্ব সমাপ্ত হয় না। তা ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে গ্রহণ করছে, সে বিষয়েও নজর রাখা দরকার। শুধু শিক্ষক নন, সরকারেরও দায়িত্ব বর্তায় বইকি। নৈতিকতা জোর করে কাউকে গ্রহণ করাতে বাধ্য করা যায় না। যদি না সে নিজে তা গ্রহণ করতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে মা-বাবার দায়িত্বও অনেক।
হাজার হাজার বছর ধরে মহামানবদের বাণী আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। সবাই প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, তা নয়। কিন্তু তাঁদের নৈতিক শিক্ষার খামতি ছিল না। বরং সেই শিক্ষার প্রভাব প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সেই নৈতিক শিক্ষা তাঁরা পেয়েছিলেন পরিবার থেকে, বিশেষ করে মায়ের থেকে। সন্তানের নৈতিক শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম মা। তিনি যতটা শেখাতে পারেন, শিক্ষক বা সমাজ ততটা পারে না।
বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের একটি বিশাল অংশের মধ্যে গুরুজনদের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং পড়াশোনার প্রতি অবহেলা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাস-ফেল প্রথা কিছু স্তরে উঠে যাওয়াও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া বর্তমান ভোগবাদী সমাজে প্রলোভনের প্রচুর উপকরণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় তৈরি করছে। ফোন, ইন্টারনেট, কেব্ল টিভির রমরমারি খানিক ভূমিকা রয়েছে।
যৌথ পরিবার ভেঙে পড়েছে। এক বা দুই সন্তানের পিতামাতা সন্তানকে আঁকড়ে রেখে দিচ্ছেন নিজেদের মতন করে। সেইসব শিশুসহজেই সব পেয়ে যাওয়ার কারণে আর কাউকেই মানছে না। তারা জানে, তাদের শাসন কেউ করবে না। ফলে, বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে খুব সহজেই। এখন এমন অবস্থা হচ্ছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রের অদ্ভুতুড়ে চুলের ছাঁট দেখে আতঙ্কিত হয়ে আসে সাবধান করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তা নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে। বিষয়টা এক ভয়াবহ নৈতিক বিপর্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
অল্পবয়সী মাদকাসক্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। সহজে টাকা রোজগারের জন্য বিপদগামী হতেও দ্বিধাবোধ হচ্ছে না। এক সার্বিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন বর্তমান প্রজন্মের এক বিশাল অংশ। উত্তরবঙ্গ এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। চারদিকে বিদেশি রাষ্টের সীমানা ঘেরা। এই অঞ্চলের ছাত্র তথা যুব প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয় তাই বেশি করে ভাবায়। সরকারের দ্রুত এই বিষয়ে যথাযথ প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে নৈতিক মানের অবক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য। এবং পরিবার, শিক্ষককুল সকলকেই সচেতন থাকতে হবে।
(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy