প্রতীকী ছবি।
করোনার আক্রমণে মানুষ অনেক কিছুই হারিয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি বোধ হয় হল ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়নে। যখন ঘোষণা হল, করোনার কারণে উচ্চ মাধ্যমিকে সব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না, কথার ছলেই এক বন্ধুকে এ কথাটা বলেছিলাম।
অবস্থা যে এতটা খারাপ হবে, তখন ভাবা যায়নি। অশনি সঙ্কেত পাওয়া গেল ফল প্রকাশের পর। দেখা গেল, পরিচিত বেশ কিছু ছেলেমেয়ে অভাবনীয় নম্বর পেয়েছে। রহস্যের জট কাটল, যখন জানা গেল, যে ছাত্র যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, তার না দিতে পারা পরীক্ষাগুলিতে সেই নম্বরই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ হয়তো ইংরেজিতে পেয়েছে ৯০, পদার্থবিদ্যা-রসায়ন পরীক্ষা হয়নি, তাই তার মার্কশিটে দেখা গেল সে ইংরেজি পদার্থবিদ্যা রসায়ন, সবেতেই ৯০ পেয়েছে। প্রাপ্ত সর্বমোট নম্বর খুবই চমকপ্রদ। ইংরেজিতে ৯০ পেয়েছে শুনে এখনকার দিনে চমকে ওঠার কারণ নেই, এমনও ভাবার কারণ নেই যে, এটা একটা দৃষ্টান্তমূলক ব্যাপার। দিন পাল্টে গিয়েছে। যে ইংরেজিতে ৯০ পাচ্ছে, সে পদার্থবিদ্যায় ৬০ পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু করোনা-আবহে নম্বরের হরির লুটের বাজারে সে ৯০ পেয়ে গেল। সিবিএসই এবং আইসিএসই বোর্ড অন্য পথ নিয়েছে, ছাত্রের প্রদত্ত পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের গড় বসিয়েছে না-হওয়া পরীক্ষার ক্ষেত্রে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি কিছুটা ভাল, তবে এ নিয়েও বিতর্কের অবকাশ আছে।
স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে, যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা নেওয়া গেল না, সেই সব বিষয়ে কেউ স্নাতক (অনার্স) স্তরে পড়তে চাইলে তার আলাদা প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে নির্বাচন যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তা হবে না, কারণ অতিমারির জেরে বাড়তি পরীক্ষা আয়োজন করা কার্যত অসম্ভব।
কলেজে ভর্তির ছবিটা আজ কেমন? সংবাদমাধ্যমে খবর, ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েও অনেক পড়ুয়া কলেজে ভর্তি হতে পারছে না, ভর্তির সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই সঙ্কটের কারণ কী? পশ্চিমবঙ্গে স্নাতক স্তরে আসন আছে ছয় লক্ষ ষাট হাজার, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে এর থেকে বিশ হাজার বেশি ছাত্র-ছাত্রী। অর্থাৎ, পাশ করা ছেলেমেয়ের থেকে আসন তিন শতাংশের মতো কম। আজকের সঙ্কট কি এই তিন শতাংশের ঘাটতির কারণে? মনে হয় না। বলতে খারাপ লাগলেও, বাস্তবকে অস্বীকার করার উপায় নেই— সারা দেশে বহু ছেলেমেয়ের পড়াশোনা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেই শেষ হয়ে যায়। এই সংখ্যাটা তিন শতাংশের বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তা হলে?
আসলে গোল বেধেছে অন্য জায়গায়। যার ৬০ শতাংশ নম্বর পাওয়া স্বাভাবিক ছিল, সে যখন ৮৫ বা ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে যায়, তার আশাও হয়ে যায় ঊর্ধ্বমুখী। ফল: যে কলেজে এমনিতে তার ভর্তি হওয়ার কথা, তার পরিবর্তে সে ভর্তির আবেদন করে এমন কলেজে, যেখানে সে পড়ার কথা কখনও ভাবেইনি। কলকাতার একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতি বছর গড়ে ৩৪ হাজার আবেদন জমা পড়ে, এ বার সেখানে জমা পড়েছে ৫৩ হাজার আবেদন।
ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এই সঙ্কটের চরিত্র বোঝা কঠিন। এক জন শিক্ষার্থীর পক্ষে আরও কঠিন, বিশেষত যখন তার প্রাপ্ত নম্বর অভাবিত রকম বেড়ে গিয়েছে, এবং সেটা হয়েছে বাকি সকলের ক্ষেত্রেই। আসলে মাপকাঠিটাই অনেকটা উঠে গিয়েছে। এর ফলে অবধারিত ভাবেই আসছে উপেক্ষিত বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার যন্ত্রণা, তরুণ মনে যা খুব কষ্টের। এর সঙ্গে এ বছর যুক্ত হয়েছে বাড়ির কাছের কলেজে ভর্তি হতে চাওয়ার প্রবণতা, অবশ্যই করোনার কারণে। সে-ও সঙ্গত, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে যা বোঝা যাচ্ছে— সমস্যাটা কলেজে প্রার্থিত আসন না-পাওয়ার নয়, হঠাৎ করে যে একটা আশা জেগেছিল, সেই আশাভঙ্গের সমস্যা।
এ সময়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অভিভাবকদের ছেলেমেয়েকে বোঝানো— নামী কলেজে সুযোগ পাওয়া মানেই মোক্ষলাভ নয়। বহু আইএএস, আইপিএস, নামী শিক্ষক, অধ্যাপক পড়াশোনা করেছেন তথাকথিত ‘সাধারণ’ কলেজে। সেই সব কলেজেও বহু অসাধারণ শিক্ষক আছেন। কিন্তু বাবা-মায়েরা নিজেরাই ছেলেমানুষিতে শামিল হলে বড় বিপদ।
এ বছর ভর্তি প্রক্রিয়া পুরোটাই অনলাইন। এর খুবই প্রয়োজন ছিল। আর এক ধাপ এগিয়ে যদি মেধা তালিকা এ বারের মতো আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ না করে একসঙ্গে করা যায়, তা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক চিত্রটা বুঝতে অনেক সুবিধে হত। ভবিষ্যতে এ কথা মাথায় রাখলে ভাল। অনেক ক্ষেত্রে একই ছাত্রের নাম সাত-আটটি কলেজে উঠেছে। যদি ভর্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় ও এমন ব্যবস্থা করা যায় যে কেউ কোথাও ভর্তি হলে তার নাম আর কোনও কলেজের মেধা তালিকায় থাকবে না, নীচের নামগুলি ক্রমশ উঠে আসবে, তা হলে তা খুবই কাজের এবং মানবিকও হবে। বহু ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকের দুশ্চিন্তা দূর হবে। আজ প্রযুক্তির যে প্রগতি হয়েছে, তাতে এ খুব কঠিন কাজ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy