Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sundarbans

ওদের রক্তে জোয়ার-ভাটা খেলে

হাতেকলমে যখন বিজ্ঞানের নানান পরীক্ষা করে দেখাচ্ছিলাম, ছেলেমেয়েগুলোর ভাবখানা এমন, যেন ম্যাজিক দেখছে!

মন্মথ রায়, দেবরাজ কোলে
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০০
Share: Save:

ছেলেমেয়েগুলো ক্লাসে পিছনের দিকে বসে জটলা করছিল। শিক্ষকরা একটু বকে দেন। বলেন, “পড়াশোনায় এদের এক ফোঁটা মন নেই।” গত ডিসেম্বরে সায়েন্স ক্যাম্প করতে গিয়েছিলাম সুন্দরবনে। হাতেকলমে যখন বিজ্ঞানের নানান পরীক্ষা করে দেখাচ্ছিলাম, ছেলেমেয়েগুলোর ভাবখানা এমন, যেন ম্যাজিক দেখছে! তার পর যখন ব্যাখ্যা করলাম সেই ম্যাজিকের কারণ, তখন আর উৎসাহ নেই হাতে গোনা কয়েক জনের ছাড়া।

সেই ক্লাস শেষ করে খাওয়াদাওয়া, তার পর ওদের সঙ্গে গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে আড্ডা হল। কথা শেষ হয় না। একটু একটু করে এগোচ্ছি আর একটার পর একটা বিষয় নিয়ে অবলীলায় বলে চলেছে সেই পিছনের বেঞ্চে বসা একটা ছেলে। চিনিয়ে দিচ্ছে গাছপালা; নোনাজল আর মিষ্টি জলের মাছেদের পার্থক্য; কী ভাবে বাঁধ দিতে হয়, কোন গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হয়— এ রকম কত কিছু। ক্লাসরুমের অনুৎসাহ, শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে গুরুগম্ভীর সম্পর্ক আর নেই। খোলামেলা ব্যাপার। গল্প করছে বন্ধুর মতো। বুঝেছিলাম, কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছিল। ভাবার চেষ্টা করছিলাম, এই ছেলেগুলো ক্লাসরুমের বাইরে এ রকম স্মার্ট আর স্বতঃস্ফূর্ত, আর ভিতরে গেলেই ও রকম নিস্তেজ বা উদাসীন হয়ে পড়ে কেন? পরে ওখানকার এক বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “ওরা বইয়ে যা পড়ে, তার সঙ্গে ওদের জীবনের বা বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই, আবার জীবন থেকে বা বাস্তব থেকে যা শেখে, তার সঙ্গে বইয়ের তেমন সম্পর্ক নেই।” কথাটা ভাবিয়েছিল বেশ।

আঠারো ভাটির দেশ সুন্দরবন। অনন্ত কাল ধরে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে মানুষের জীবনযাত্রা-জীবিকা। মাধ্যমিকের ভূগোল বইয়ে জোয়ার-ভাটা নিয়ে কত কথা লেখা থাকে। চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ বল, পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ বল, আহ্নিক গতি, মুখ্য জোয়ার, গৌণ জোয়ার, চাঁদ-সূর্য-পৃথিবীর সরলরৈখিক-সমকৌণিক অবস্থান, ভরা কটাল-মরা কটাল— সব পেরিয়ে যখন আমাদের শর্ট কোয়েশ্চেন-লং কোয়েশ্চেন, আন্ডারলাইন করে ক্লাসের শেষ দিকে পৌঁছয়, তখন আর মন লাগে না।

বাবার সঙ্গে জোয়ার-ভাটার সময় হিসেব করে ডিঙি ভাসিয়ে মাছ ধরে নিয়ে এসে, জেটিঘাটে বিক্রিবাটা করে আসা সুন্দরবনের জোয়ার ভাটার নাড়ি-নক্ষত্র জানা আমাদের ছাত্রগুলো, ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চে বসে হয়তো ঘুমে ঢলে পড়ে। বা মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। এর পর তাকে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হবে একটা শর্ট কোয়েশ্চেনের উত্তর। জোয়ার-ভাটার একটি সুফল বল! বইয়ে মোটা মোটা হরফে লেখা উত্তরটি মুখস্থ বলে দিতে হবে তাকে— “জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশগুলিতে প্রচুর পরিমাণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।” না বলতে পারলেই স্যরের ধমক।

অথচ তারা জোয়ার-ভাটার ছন্দে বড় হয়েছে। জোয়ার-ভাটার সুফল-কুফল তাদের মুখস্থ করতে হয় নাকি? তারা প্রতি দিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, ভাটায় ডিঙি ছেড়ে দিতে হবে দূর নদীতে রওনা দিতে। মাছ ধরা শেষ করে জোয়ারে ফিরতে হবে ঘাটে। তারা জানে, জোয়ারে ভেসে আসা টুকরো ডালপালা ছাঁকনি জাল দিয়ে ধরে শুকিয়ে নিতে হয়। ইস্কুল যাওয়ার আগে ভাত ফোটে তো ওই ডালপালার জ্বালেই। জোয়ারে খাঁড়িতে জল ঢুকলে বা ভাটায় জল নেমে গেলে জমে থাকা ‘চৌকো’র জলে ‘খেবলা’ জাল দিয়ে ধরতে হয় ছোট-বড় মাছ। কিছু খায়। কিছু বিক্রি করে পয়সা জমে। আবার জোয়ারের জলেই ভেসে আসে নোনাজলের নানা গাছের বীজ। সেই বীজই ভাটার সময়ে চরে গেঁথে গিয়ে তৈরি হয় ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। প্রকৃতির কী অপার রহস্য! একে অপরকে জড়িয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু এ সব কি আর লেখা যায় পরীক্ষার খাতায়? না কি বইয়েই লেখা থাকে? তাই জীবন আর বিজ্ঞান ক্রমেই আলাদা হয়ে যায় আমাদের সুন্দরবনের ব্যাকবেঞ্চারদের কাছে।

আমাদের সিলেবাসের বিজ্ঞান ওই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনমুখী। এই বিজ্ঞানে মন মজে না তাই। আমাদের ইঁদুর দৌড়ের জীবনে, একে অপরকে ঠেলেঠুলে রেষারেষির শিক্ষাজগতে এরা চির কালই পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রী, ব্যাকবেঞ্চার। সংজ্ঞা মুখস্থ করে গুচ্ছের নম্বর তুলে যারা এগিয়ে যাই, তারা হয়তো ওই জলবিদ্যুৎ তৈরির কাজে লাগি। বা, নেহাত একটু বিকল্প বিজ্ঞানচর্চা করি। কঠিন কঠিন নাম দিই। স্যালিয়েনেশন-ডিস্যালিয়েনেশন, বায়োমিমিক্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মাঝেই বছরের পর বছর ধরে কমতে থাকে ম্যানগ্রোভের দেওয়াল। উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়ে সর্বস্ব ভোগের চাহিদায় বাড়তে থাকে দূষণ। হিমবাহের বরফ গলে। এক দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে, অন্য দিকে ঘেঁটে যায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিতলের উষ্ণতার ভারসাম্য। বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড়। আয়লা, ফণী, বুলবুল, আমপান...।

আমপানের পর ওদের সঙ্গে বহু কষ্টে যোগাযোগ হল। শুনলাম, আমরা যখন সরাসরি পৌঁছতে পারছিলাম না যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতার কারণে, ওরাই রেশন বিলিয়েছে, আবার বাঁধ সারানোর কাজে হাত লাগিয়েছে প্রথম কয়েক দিন। তাজ্জব ব্যাপার হল, ওদের প্রত্যেকেই সেই ছেলে, যারা ক্লাসের ‘ব্যাকবেঞ্চার’ হিসেবে পরিচিত। ওরা প্রথম কয়েক দিন বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এসে আমাদের নিয়মিত ফোন করেছে, খবর দিয়ে গিয়েছে।

তার পর আমরা যখন গিয়েছি, তখন ওরাই নিয়ে গিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়। আমাদের সঙ্গে কাজে হাত লাগিয়েছে। গণরসুই বা ‘পিপলস কিচেন’ চালাচ্ছে। খাবার রান্না থেকে শুরু করে মানুষের পাত অবধি পৌঁছনো, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য সোলার লাইট দেওয়া— কোনওটাই সম্ভব হত না, যদি এরা মাঠে হাজির না থাকত।

যখন সোলার ল্যাম্প দিয়ে ফিরছিলাম, আমাদের সেই ছাত্রটি বলছিল, “স্যর, মনে আছে ওই আমাদের স্কুল? আপনারা এসেছিলেন।...এখানেই বাঁধটা ভেঙেছে। একে ঝড়। তার ওপর ভরা কটালের ঢেউ। নদীর বাঁকটা এখানটাই তো। তাই জলের প্রেশার বেশি থাকে...।”

বুঝতে পারছিলাম, আমাদের আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি ওদের প্রকৃতিসিদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ততাকে ধারণ করতে পুরোই ব্যর্থ হয়েছে, দিনের পর দিন।

অন্য বিষয়গুলি:

Sundarbans Children Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy