বইমেলায় মানুষজন।
শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে চলছে ৩৭তম উত্তরবঙ্গ বইমেলা। উত্তরের বইমেলার আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। শুধু বই দেখা, কেনা নয়, সঙ্গে আরও অনেক কিছু। যেমন, আড্ডা। যেমন, ফুচকা, ঝালমুড়ি।
বইমেলা অভিজাত আড্ডাক্ষেত্র। মেলায় বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থা ও লিটল ম্যাগাজিনের একাধিক স্টল পসরা সাজিয়ে বসেছে। বইয়ের সম্ভার কোনও অংশে মন্দ নয়। স্টলগুলিতে ভিড় নেই, সে কথাও বলা যায় না। কিন্তু বই কিনে পড়ার লোক হাতে-গোনা গুটিকতক! প্রযুক্তির যুগে তরুণ প্রজন্ম কতটা সময় বই পড়ার জন্য ব্যয় করছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যায়।
নব্বই দশকেও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার ঝোঁক প্রবল ছিল। অভিভাবকের ধারালো দৃষ্টি এড়িয়ে পড়ার বইয়ের ভাঁজে চাচা চৌধুরী, টিনটিন, ফেলুদা, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার নিয়ে কেটে গিয়েছে কত বেলা-অবেলা। আসলে, বইপোকাদের বাঁধাধরা নিয়মের প্রয়োজন হয় না। আর তখন বিনোদনের মাধ্যম ছিল টুকটাক কিছু দেশি খেলা আর ছিল বই।
সে সময় বই সংগ্রহ করাও ছিল কঠিন ব্যাপার। সব জায়গায় গ্রন্থাগার ছিল না। শহরের গ্রন্থাগারে বড় কাউকে পাঠিয়ে বই হাতে পাওয়া যেত। অথবা, অন্য কারও কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়ে তা ফেরত দিতে হত। বই কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ হাতে থাকতও না। জেলায় জেলায় তখন বইমেলা এত আড়ম্বরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত না। বছরে একবার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা হত। সেই মেলায় প্রতি বছর যাওয়াও সম্ভব হত না।
কিন্তু সময় এখন বদলে গিয়েছে। শিক্ষার ধারা হয়েছে আধুনিক। শিক্ষক পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সার্বিক জ্ঞান, বোধ আর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য নানা বই পড়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া হয়। উত্তরের জেলায় জেলায় বইমেলা হচ্ছে এখন প্রতি বছর। একাধিক সংগঠন বইপাঠে আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বইপাঠ দিবস পালন করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্যান্য গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস যে শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম, তা সব সময় সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। ই-রিডার এবং অন্যান্য প্রযুক্তিতেও বই এখন হাতের মুঠোয়!
কিন্তু এত আয়োজনের পরও যথার্থ পাঠক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ, বর্তমান প্রজন্ম পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তারা ক্রমগত সাজেশন-ভিত্তিক পড়াশোনায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। কেরিয়ার সচেতন হয়ে উঠতে গিয়ে তাদের বাইরের জগত সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি দিন দিন কমছে। গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়ে পড়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে আসছে। অথচ, বই কেবলমাত্র কিছু অক্ষর নয়, লেখকের চিন্তার ফসল। বইয়ের মধ্যে লিপিবদ্ধ থাকে সভ্যতার ইতিহাস। বই পারে মানুষকে আলোর দিশারি করে তুলতে। বইয়ের মাধ্যমেই একটি মানুষ পর্যটকের ভূমিকায় ঘুরে বেড়াতে পারেন, পারেন স্বপ্ন দেখতে।
এখনকার ছেলেমেয়েরা সামাজিক মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে। সাময়িক বিনোদনে তারা মত্ত। নিজেদের অজান্তেই নষ্ট করে দিচ্ছে মূল্যবান সময়ের বৃহত্তর অংশ। ফলে, শৈশবের, কৈশোরের, তারুণ্যের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তারা অল্পেই হয়ে পড়ছে অসহনশীল, হতাশাগ্রস্ত। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বই পড়াকে অপরিহার্য বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ, বই পারে মনের দীনতা দূর করতে। যার বই পড়ার অভ্যাস যত বেশি, তার জানার পরিধিও তত বেশি। তাই বই পড়ার অভ্যাস নিজরুরি। প্রতিটি মা-বাবারই উচিত সন্তানকে বয়স অনুযায়ী বই পড়ার প্রতি উৎসাহ দেওয়া। হাতে বই তুলে দেওয়া।
প্রায় সব বইমেলা প্রাঙ্গণেই এখন বইয়ের স্টল ছাড়াও থাকে সাংস্কৃতিক মঞ্চ। মেলা চলাকালীন সেখানে চলতে থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। থাকে কবিতা পাঠের আয়োজন। এ সবই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় বইমেলায়। আর বই হয়ে দাঁড়ায় গৌণ, যা কোনওভাবেই কাম্য নয়। তবু কিছু মানুষ এখনও বইমেলার জন্য, নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জাতিবৈচিত্রে ভরপুর। বই পারে তাদের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যম হতে। তাতে সামাজিক একতা বৃদ্ধি পাবে। ব্যক্তিক বিকাশও সম্ভবপর হবে।
(লেখক ইসলামপুরের মণিভিটা হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy