—প্রতীকী চিত্র।
রাহুল নবম শ্রেণির ছাত্র। ছেলেটি ইদানীং দেরি করে স্কুলে আসছে। নতুন স্টাইলে মাথার চুল কেটেছে। সে প্রচণ্ড জেদি ও মেজাজি। ক্লাসে আজকাল পড়াশোনায় মন দেয় না। এক দিন ক্লাস-টিচার ছেলেটির ব্যাগ খুঁজে কয়েকটা বিড়ি বের করলেন। রাহুলের এই সব আচরণ শিক্ষককে চিন্তায় ফেলল। ভাবছেন হয়তো, এখানে এক জন বিগড়ে-যাওয়া ছেলের গল্প শোনানো হচ্ছে। না, ঠিক তা নয়, তবে রাহুলের উদাহরণ দিয়ে যে-বিষয়টির উপর আলোকপাত করতে যাচ্ছি, সেটা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়—স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের দায়িত্ব।
বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে এখন নানা চর্চা। আসলে এই সময়টা ছেলেমেয়েদের বিকাশের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তর, যে-স্তরে তাদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলি হড়পা বানের মতো হঠাৎ ও ব্যাপক ভাবে চলে আসে। কিন্তু ওই সময়ের জন্য কোনও আগাম প্রস্তুতি তাদের মধ্যে থাকে না। এটাও সত্যি, অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা বা অভিভাবক কিশোর-কিশোরীদের এ বিষয়ে প্রাক্-সচেতন করেন না, যার ফলে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। বয়ঃসন্ধিক্ষণে ছাত্রছাত্রীদের দৈহিক ও মানসিক সমস্যাগুলি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যত-না চিন্তায় ফেলে, তার চেয়ে ঢের বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলে ওদের আবেগজাত, আচরণগত ও সামাজিক সমস্যাসমূহ।
বয়ঃসন্ধিকাল কমবেশি সব ছেলেমেয়ের উপরেই প্রভাব ফেলে। কিন্তু, কয়েক জনের ক্ষেত্রে এই প্রভাব সাংঘাতিক। তখন শরীরে নানা বদল আসে। পরিবর্তন আসতে থাকে মনেও। শরীর আর মনে হানা দেয় বিচিত্র সব সমস্যাও। এই ,সময়ে ছাত্রছাত্রীদের অনেককেই ঘিরে ধরে হরেক সমস্যা, অভিমান, অবসাদ। তা ছাড়াও, এই বয়সে প্রায় সকলের মনেই উঁকি মারে নানা প্রশ্ন। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? অনেক সময়ে বাবা-মা ‘বন্ধু’ হিসেবে সন্তানদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করলেও পারেন না। আবার ছেলেমেয়েদের মনে উঁকি মারা কৌতূহলকে অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু, প্রশ্নের উত্তর না-মেলায় অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়ে। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরাও বাড়ির বড়দের সঙ্গে নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে কুণ্ঠা বোধ করে। মনের কথা মনেই চেপে রাখতে রাখতে অনেকে হতাশায় ভুগতে শুরু করে। সেই হতাশা থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ। অনেকে বেছে নেয় চরম পথ।
এখানেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত, ছেলেমেয়েদের বিকাশের এই স্তরটি হল ‘ঝড়-ঝ্ঞ্ঝার স্তর’। এই ঝড় কিশোর-কিশোরীদের উপরে সরাসরি আছড়ে পড়লেও, এর সমপার্শ্বিক প্রভাব থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও রেহাই পান না। কেননা স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যাগুলি থেকে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না। অত্যন্ত মেজাজি হওয়ার কারণে কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে স্কুলে তর্কাতর্কি ও মারপিট করে। কেউ কেউ আবার ক্লাসে অন্যদের উপরে ‘দাদাগিরি’ও ফলাতে চায়। ক্লাসে এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বহু অভিযোগও পেয়ে থাকেন। কখনও কখনও ছেলেমেয়েরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে ও অভব্য আচরণ করে।
কেউ কেউ আবার চুপ করে সারাটা দিন এককোণে বসে থাকে। কারও সঙ্গে মেশে না। আর পাঁচ জন কিশোর-কিশোরীর মতো তাদের মন থাকে না খেলাধুলোয়। পড়াতেও তারা অমনোযোগী। ক্লাসের মধ্যে পড়ুয়াদের ঔদ্ধত্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, শিক্ষার্থীকে সহৃদয় ও বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা বারবার দেওয়া জরুরি। মাঝে মাঝে গল্পের মাধ্যমে ওদের মধ্যে কোমল স্বভাবসমূহের সঞ্চার করা যেতেই পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা একটু একটু করে স্বাধীনচেতা হতে শুরু করে। তারা ভাবতে শুরু করে, অনেক কিছু করার ক্ষমতা তারও আছে। স্কুলের যে কোনও অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘স্যার/ম্যাডাম আমাকে এটা করতে দিন, ওটা করতে দিন’। কিছু কিছু শিক্ষার্থী চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে মুখ ফুটে তাদের আত্মসক্রিয়তার বিষয়টা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলতে চায় না। আবার অধিকাংশ সময় ওদেরকে গুরুত্বও দেওয়া হয় না। ফলে সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে, শিক্ষক-শিক্ষিকা সেই পড়ুয়ার ক্ষমতা, আগ্রহ, ও রুচি অনুযায়ী তাকে কাজে নিযুক্ত করবেন, যাতে তার সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে। একই ভাবে কাজে সফলতা অর্জনে তাকে সাহায্য করতে হবে, উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে।
এই বয়সের অনেক ছাত্রছাত্রীই নতুন নতুন চুলের স্টাইলে অভ্যস্ত হতে চায়। ক্লাসে, বিশেষ করে ছেলেদের মাথার দিকে চোখ রাখলেই দেখা মেলে উদ্ভট উদ্ভট চুলের বাহার। আজকাল আবার চুলে রকমারি রং লাগাতেও দেখা যায়। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের অনেকের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রবণতাও বেড়ে যায়। কোনও দোষ-ত্রুটি করলে সহজে স্বীকার করতে চায় না। এ সবের কারণ অবশ্যই ওদের মনের গহনে সুপ্ত-থাকা ভয়। কিশোর-কিশোরীদের আচরণগত সমস্যাগুলি সমাধান করতে হলে, ওদের আস্থা অর্জন করাটা অত্যন্ত জরুরি।
বিকাশের এই স্তরে বিশেষ করে বেশ কিছু ছাত্র সহজেই নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সময় তারা কুসঙ্গীর প্রভাবে বিড়ি, সিগারেট, বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য, গুটকা, আঠা ইত্যাদির সেবন শুরু করে। যেটাকে ওরা ক্ষণিকের ‘থ্রিল’ হিসেবে শুরু করে, সেটা ভবিষ্যতে একটি দীর্ঘকালীন জীবননাশী বদ অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, যদি কুঁড়ি অবস্থাতেই ওই সব আসক্তি থেকে তাদের দূরে সরিয়ে না রাখা হয়। এই সমস্যা আরও ঘোরাল হয়, যখন স্কুলের আশপাশে নেশার দ্রব্যগুলি সহজলভ্য হয়। তাই ছাত্রদের উপরে সতর্ক নজর না রাখলে, ওরা নেশার জগতের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েই রয়ে যাবে।
কিশোর-কিশোরীদের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি না জুটলে, তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ঋতুমতী মেয়েরা প্রায়ই রক্তাল্পতায় ভোগে। স্বাস্থ্য দফতর থেকে আজকাল স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের সপ্তাহে একটি করে আয়রন ট্যাবলেট এই উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, যাতে তাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গ্রামের স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীরা এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায় না। তার একটা বড়ো কারণ হল, অধিকাংশ অভিভাবক-অভিভাবিকাই এ ব্যাপারে সচেতন বা আগ্রহী নন।
সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও গোঁড়ামি এর অন্যতম কারণ। এখানেও স্কুলের ভূমিকা আছে। প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকা, ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিককে অভিভাবকদের আরও বোঝাতে হবে। আরও বেশি স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির করতে হবে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কিশোর-কিশোরীদের এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুই হল আত্মহত্যাজনিত, যার একমাত্র কারণ হল ‘ডিপ্রেশন’। হীনমন্যতা ওদের কচি মনে ক্ষত সৃষ্টি করে। তাই অনেক সময় পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্টের জন্য তারা আত্মহননের মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। ওদের দুঃসময়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপ ওদের জীবন বাঁচাতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার আগমন কিশোর-কিশোরীদের জীবনকে অভুতপূর্ব ভাবে প্রভাবিত করেছে। স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা স্মার্টফোন আনার সুযোগ না পেলেও, বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তারা তাকিয়ে থাকে। এতে ওদের শারীরিক সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা তো থাকেই, উপরন্তু পড়াশোনার ক্ষতিও হচ্ছে। এখন এটিও এক ধরনের নেশা বা ‘অ্যাডিকশন’-এ পরিণত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উচিত, ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকেই স্মার্টফোনের খারাপ দিকগুলো বেশি বেশি করে তুলে ধরা।
ঋতুকালে পেটে এত ব্যথা হয় কেন? প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া কি অন্যায়? বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের এই প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যৌন কৌতূহল দেখা যায়। এটা অবশ্য প্রকৃতিগত ঘটনা। অসুবিধা হল, এরা নিজেরাও যেমন এ সম্পর্কে ঠিকঠাক সচেতন নয়, তেমনি বাবা-মাও বাড়িতেও সেই খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ থাকে না। বিশেষ করে কো-এড স্কুলগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের ‘প্রেমপত্রে’র আদান-প্রদান থেকে শুরু করে হাতের ব্লেড চালিয়ে ‘প্রেমিক-প্রমিকার’ নাম লেখার রেওয়াজ বহুদিনের। এর পিছনেও সেই বয়ঃসন্ধিজনিত উত্তেজনা। কখনও কখনও শোনা যায় যে, নবম-দশম শ্রেণির ছেলেমেয়ে এই অপরিপক্ক বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে। শিক্ষক-শিক্ষাকারা অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করে সময়মতো ‘কাউন্সেলিং’ করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
তবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কর্তব্যসমূহের কথা বলা হলেও, অভিভাবকদের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। ছেলেমেয়েরা যে কোনও সমস্যাতেই পড়ুক না কেন, অভিভাবকেরা তা নিয়ে খোলামনে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করতেই পারেন। উল্টোটাও হতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীদের মঙ্গলে একটু কড়া মনোভাব দেখানোর দরকার হয়, তাহলে সেটাও চেষ্টা করে দেখতে হবে।
এ ক্ষেত্রে স্কুলে নিয়মিত ভাবে অভিভাবক সভার (পেরেন্ট-টিচার মিটিং) আয়োজন করলে তার সুফল তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব। বয়ঃসন্ধিকাল হল শৈশবাবস্থা থেকে বয়ঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত কয়েক বছরের দীর্ঘ যাত্রা। তাই ওই সব অনভিজ্ঞ ‘যাত্রী’-কে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব অভিভাবকএবং শিক্ষকদেরই নিতে হবে।
লেখক সেকেড্ডা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy