Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Education

শিক্ষা ফিরে এল, নামেই? সুবিধাভোগীর কেরিয়ার গড়া হবে, বাকিরা মোট বইবে

খোলা মনে নানা মত শোনার এবং তা নিয়ে সৎ ভাবে চিন্তা করার স্বভাব বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদের আচরণে দেখা যায় না, দৃশ্যত তাঁরা বিশ্বাস করেন— ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২০ ০০:৪৬
Share: Save:

কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন শিক্ষা নীতির খসড়া নিয়ে আগে এক প্রস্ত বিতর্ক হয়েছে। এ-বার, সেই নীতির চূড়ান্ত রূপটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ার পরে, নতুন করে বিচার বিশ্লেষণের পালা। শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদরা এই নীতির সামগ্রিক কাঠামো ও চরিত্র নিয়ে এবং বিভিন্ন নির্দিষ্ট দিক নিয়ে আলোচনা করছেন, করবেন। আমরা সেই আলোচনায় সমৃদ্ধ হব। রাষ্ট্রযন্ত্রের যন্ত্রীদের কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে, তাঁরাও সমস্ত মতামত খোলা মনে শুনবেন, তা নিয়ে সৎ ভাবে চিন্তা করবেন, শিক্ষা নীতি রূপায়ণের সময় সেই ভাবনা কাজে লাগাবেন। শিক্ষা কেন্দ্রের একার বিচার্য বিষয় নয়— অন্তত এখনও নয়— রাজ্য সরকারগুলিরও বড় ভূমিকা আছে। খোলা মনে নানা মত শোনার এবং তা নিয়ে সৎ ভাবে চিন্তা করার স্বভাব বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদের আচরণে দেখা যায় না, দৃশ্যত তাঁরা বিশ্বাস করেন— ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলির কর্তা এবং কর্ত্রীরাও যে সচরাচর গণতান্ত্রিক শুশ্রূষার বিশেষ পরিচয় দিয়ে থাকেন, এমনটা বলা যাবে না। তাই, নতুন শিক্ষা নীতি একটা যথার্থ আলোচনা-নির্ভর গণতন্ত্রের অনুশীলনের প্রকরণ হয়ে উঠবে, সে ভরসা কম। হয়তো ইতস্তত কেন্দ্র-রাজ্য বিতণ্ডা চলবে, কিন্তু সে-সব নেহাতই ক্ষমতার দড়ি টানাটানি। সেই কুনাট্যে আমাদের জন্য দর্শকের আসনই নির্দিষ্ট।

আপাতত সেই আসনে বসে একটা অন্য কথা ভাবা যাক। নামের কথা। কেন্দ্রীয় সরকার বলে দিয়েছেন, এখন থেকে ‘মানব সংসাধন বিকাশ মন্ত্রক’-এর নাম হবে শিক্ষা মন্ত্রক। এটি নতুন নামকরণ নয়, পুরনো নাম ফিরে পাওয়া। আশির দশকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রবর্তনের সময় শিক্ষা মন্ত্রকের নতুন পরিচয় হয়েছিল ‘মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান রিসোর্স ডেভলপমেন্ট’। কেবল একটির বদলে তিনটি শব্দ নয়, নামখানি রীতিমত জমকালো, জোরে বললে গর্জনের মতো শোনায়। এখন, চৌত্রিশ বছর পরে, নরেন্দ্র মোদী বলেছেন: পুনর্মূষিকো ভব। ভালই করেছেন। একটি সহজ শব্দে যা বোঝানো যায় তার জন্য তিন-তিনটি গ্রাম্ভারি শব্দের দরকার কী?

তবে সেটা গৌণ ব্যাপার। বড় কথাটা হল চৌত্রিশ বছর আগেকার ওই নামকরণের তাৎপর্য নিয়েই। প্রথমত, ভাষান্তরের ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। বাংলা ভাষায় হিউম্যান রিসোর্স ডেভলপমেন্ট-এর প্রতিশব্দ হিসেবে প্রচলিত হয়েছে: মানব সম্পদ উন্নয়ন। অনেক দিন হল আমরা এই পরিভাষাই ব্যবহার করে আসছি। ঠিক করেছি কি? দশচক্রে যা হয়, সবটাই যে ভাল হয় তা তো বলতে পারি না! এখন মনে হয়, ওই মানব সংসাধন বিকাশ-ই সম্ভবত শ্রেয়। এক, ডেভলপমেন্টকে আমরা বাংলায় সাধারণ ভাবে উন্নয়নই বলি বটে, কিন্তু তার মর্মার্থটি বিকাশ দিয়েই অনেক ভাল ধরা যায়। খেয়াল করলে দেখব, ডেভেলপ-এর মধ্যে একটা ডি-আনভেলপ ঢুকে আছে, অর্থাৎ এ হল যা অন্দরে অন্তরে আছে তাকে বাইরে আনার ব্যাপার, ফুল ফোটার মতো। ‘পুষ্পবিকাশের সুরে’ই তো লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এটা অবশ্য ঠিক যে, ডেভেলপমেন্ট ব্যাপারটাই এখন আর বিকাশের শর্ত মানে না, বরং বাইরে থেকে ঠেলে তোলার দিকে— ‘উন্নয়ন’-এর দিকে— তার বেশি নজর, কিন্তু সেই বিকৃতিকে পরিভাষা রচনায় দাম দেব কেন? দুই, রিসোর্স এক অর্থে নিশ্চয়ই সম্পদ, তবে সেই সম্পদ পরবর্তী স্তরের কোনও লক্ষ্য অর্জনের উপায়। যেমন উর্বর জমি, যে জমিতে আবাদ করলে সোনা ফলে। সোনা ফলানোর লক্ষ্যটি আছে বলেই জমি হল রিসোর্স। সাধন শব্দটি উপায় অর্থে বাংলায় স্বীকৃত। যে সম্পদ একটা লক্ষ্য অর্জনের উপায়, তার প্রতিশব্দ হিসেবে সংসাধন চলতেই পারে, কিছু কিছু লেখায় ও তর্জমায় ইতিমধ্যেই চলেছেও।

একটা খুচরো প্রশ্ন উঠতে পারে: ইংরেজি থেকে শুরু করে বাংলা পরিভাষা ভাবব কেন? বিদেশি ভাষার ওপর কেন এই নির্ভরতা? উত্তরটা সহজ: (কর্মী) মানুষ হল হিউম্যান রিসোর্স এবং শিক্ষা তার ডেভলপমেন্ট-এর উপায়— এই ধারণাটা ইংরেজি হয়েই আমাদের কাছে এসেছে, তাই।

আর ওই ধারণাটি নিয়েই, আমরা মুখোমুখি হই এক গভীরতর প্রশ্নের: মানুষকে রিসোর্স হিসেবে দেখব কেন? সে কিসের সংসাধন? কোন লক্ষ্য অর্জনের উপায়? এ-প্রশ্নের যে উত্তরে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, দীক্ষিত হয়েছি, তার নাম ‘গ্রোথ’। অর্থাৎ, উৎপাদন তথা আয়ের বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধি যত দ্রুত, দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য তত বেশি। এ-কালে তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন— জাতীয়তাবাদী উৎক্রোশ দমন করে মানতেই হবে— চিন। আমাদেরও জিডিপি’র দ্রুত বৃদ্ধি চাই। তার জন্য চাই বিবিধ সংসাধন— যথেষ্ট পরিমাণে এবং যথাযথ গুণমানের। তার মধ্যে যেমন থাকবে উর্বর জমি, উৎকৃষ্ট কাঁচামাল, উন্নত যন্ত্রপাতি ও কৃৎকৌশল, তেমনই থাকতে হবে দক্ষ কর্মী। এই জিডিপি বাড়ানোর যজ্ঞে মানুষের একমাত্র মূল্য সেই দক্ষ কর্মী হিসেবে। এবং শিক্ষা হল দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার আয়োজন।

এই যজ্ঞে প্রধান ভূমিকা যার, তার নাম বাজার, যে-বাজার উত্তরোত্তর বড় পুঁজির বশীভূত। উৎপাদন এবং আয় বৃদ্ধির গোটা ব্যবস্থাই তার নিয়ন্ত্রণে চালিত। সুতরাং, মানুষকে সেই বৃদ্ধির সংসাধন হিসেবে গড়ে তোলার বন্দোবস্তটিও ক্রমে বাজারের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা এমন এক পৃথিবীতে পৌঁছেছি যেখানে বাজার ঠিক করে দিচ্ছে মানুষ কী কাজে লাগবে, এবং সেই অনুসারে শৈশব থেকে তাকে তৈরি করা হচ্ছে। এই বন্দোবস্তটিকেই আমরা শিক্ষাব্যবস্থা নামে ডাকতে অভ্যস্ত হয়েছি। ব্যাপারটাকে অভিনব বলা চলে না মোটেই, তবে লেখাপড়া মানে শুধুমাত্র কেরিয়ারের প্রস্তুতি, আর কিছু নয়— এই অদ্বৈতবাদ, অন্তত আমাদের সমাজে, সর্বগ্রাসী হয়েছে মোটামুটি গত দু’দশকে।

প্রবণতাটি দুনিয়া জুড়েই জোরদার, তবে আমাদের দেশে আজও শিক্ষার সুযোগ, বিশেষ করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে, এতটাই সীমিত এবং সেই সুযোগের বণ্টনে বৈষম্য এতটাই তীব্র যে এই বাজার-সর্বস্বতার পরিণাম সম্পূর্ণ ভয়াবহ। সমাজের একটা ছোট অংশের ছেলেমেয়েরা ‘ঠিকঠাক’ শিক্ষার সুযোগ পেয়ে সফল ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, বাকিরা শিক্ষার নামে যে পিটুলিগোলা সেবন করছে তার বাজারদর কিছুই নেই। অর্থাৎ, বাজারের স্বার্থে এবং তারই নির্দেশে মানব সংসাধনের বিকাশ ঘটছে সংখ্যালঘু সুবিধাভোগী পরিবারে, সুযোগবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ঘরের সন্তানেরা যোগ্য সংসাধন হয়ে উঠতে পারছে না, পারবেও না। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্যটা এই যে, এমন এক নিদারুণ বৈষম্য নিয়ে এই বাজারের কোনও সমস্যা নেই, কারণ তার রিসোর্সের প্রয়োজন ওই সংখ্যালঘু ‘শিক্ষিত’রাই মিটিয়ে দিতে পারবে, বাকিরা মোট বইবে, সে মোট বড়বাজারের হোক অথবা আমাজ়নের।

নতুন নীতিতে শিক্ষা তার নামটি ফিরে পেল। কিন্তু মানুষকে বাজার অর্থনীতির সংসাধন করে তোলার দায় থেকে তার নিষ্কৃতি মিলবে কি? যতটুকু বুঝেছি, তেমন কোনও ভরসার উপাদান এই নীতিপত্রে নেই। বরং, শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথ আরও প্রশস্ত হতে চলেছে— এই আশঙ্কা সত্য হলে লেখাপড়ার জগতে বৈষম্য বাড়বে। এবং বাজার আরও বেশি দাপটের সঙ্গে ঠিক করে দেবে: শিক্ষা কী ও কেন। অতএব, আপাতত, নামমাত্র সার।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Government Covid-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy