Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ব্যাধি ও ঔষধ

গণতন্ত্রের আবহ বজায় রাখিয়া হিংসাত্মক কার্যকলাপ রুখিতে যে পদক্ষেপ করিতে হইতেছে, তাহাই যদি দীর্ঘ সময় ও বিস্তৃত পরিসর ধরিয়া চলিতে থাকে, তাহা গণতন্ত্রের মারক হইয়া দাঁড়ায়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৫০
Share: Save:

সকলই নাশ হইতে পারে, বুঝিলে নাকি প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা অর্ধেক ত্যাগ করিয়া থাকেন। ইন্টারনেট পরিষেবা আজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও নাগরিক জীবনের কতটা স্থান অধিকার করিয়াছে, অর্ধেক অথবা তাহারও অধিক, তাহার আন্দাজ সহজ নহে। নেট সংযোগ ছিন্ন হইলে কত ক্ষতি হয়, সেই হিসাবও দুঃসাধ্য। অথচ রাজ্যবাসীর নিরাপত্তা যখন বিপন্ন, তখন সেই ক্ষতি স্বীকার না করিয়া উপায় নাই। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ‘প্রতিবাদ’ করিতে রাজ্য জুড়িয়া দুষ্কৃতীরা অশান্তি করিতেছে। সেই সঙ্গে তাহাদের একাংশ ‘অস্ত্র’ করিতেছে সমাজমাধ্যমকে। বিদ্বেষ উস্কাইবার লক্ষ্যে ক্রমাগত ভ্রান্ত খবর প্রচার করিয়াছে। রাজ্য সরকার তাহার মোকাবিলায় উপদ্রুত এলাকাগুলিতে সাময়িক ভাবে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করিয়াছে। তিক্ত ঔষধ গিলিবার মতোই, সামগ্রিক ঝুঁকির বিবেচনা করিলে এই মুহূর্তে রাজ্যে ছয়টি জেলায় পূর্ণ বা আংশিক ইন্টারনেট বন্ধের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে গ্রহণ না করিয়া উপায় নাই। ঠিক যেমন করিতে হইয়াছে উত্তর-পূর্বের বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেও। পরিস্থিতির সামাল দিতে গুজব ও ‘ফেক নিউজ়’ নামক একবিংশ শতকের সামাজিক ব্যাধির মোকাবিলা অবশ্যকর্তব্য। এবং সেই লক্ষ্যেই আংশিক ও সাময়িক ইন্টারনেট বন্ধও সমর্থনীয়। ভয় হইতে আরও ভয়, হিংসা হইতে আরও হিংসার উদ্ভব, ও বিভ্রান্তিকর বার্তার প্রচার থামাইতে ইহা ব্যতীত উপায় কী।

তবে অতি সাবধানে, অতি সামান্য প্রয়োগ করিলে যে ঔষধ উপকারী, অতিরিক্ত ব্যবহারে তাহাই প্রাণঘাতী হইতে পারে। গণতন্ত্রের আবহ বজায় রাখিয়া হিংসাত্মক কার্যকলাপ রুখিতে যে পদক্ষেপ করিতে হইতেছে, তাহাই যদি দীর্ঘ সময় ও বিস্তৃত পরিসর ধরিয়া চলিতে থাকে, তাহা গণতন্ত্রের মারক হইয়া দাঁড়ায়। ভারত চিন নহে, তাহা ভারতকেই মনে রাখিতে হইবে। সামাজিক মুক্তির আবহটি বন্ধ করিয়া দিলে আসলে দেশের মূল চরিত্রটিই বদলাইয়া যায়। তাই পশ্চিমবঙ্গে বা ত্রিপুরার ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ স্বাগত, কাশ্মীরের দিকে তাকাইলে কিন্তু সেই একই পদক্ষেপের অতিব্যবহার ও দমনের বাড়াবাড়ি দেখিয়া আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় নাই। কাশ্মীরের দৌলতে ইতিমধ্যেই, ইন্টারনেট পরিষেবা রুদ্ধ করিবার তালিকায় বিশ্বে সবার শীর্ষে ভারত। ৩৭০ ধারা রদ করিবার সময়ে কেন্দ্র ‘আগাম সতর্কতা’ হিসাবে কাশ্মীরে ইন্টারনেট অচল করিয়াছিল। ৫ অগস্টের পর একশত পঁয়ত্রিশ দিন পার হইয়াছে, সংযোগ ফিরে নাই। কাশ্মীরে এমন দমনমূলক পদক্ষেপ আগেও গৃহীত হইয়াছে, কিন্তু বর্তমান মোদী সরকারের জমানায় তাহা এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় উঠিয়াছে। যত বার সে রাজ্যে নেট পরিষেবা রুদ্ধ হইয়াছে, এ বারের ‘নেটবন্দি’ দশা তন্মধ্যে দীর্ঘতম। সম্প্রতি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশ হইবার পর উত্তরপ্রদেশ, অসম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ— দেশের নানা অঞ্চলে ইন্টারনেট রুদ্ধ হইয়াছে। রামমন্দির রায়দানের সময়েও উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান-সহ নানা রাজ্যে নেটসংযোগ ছিন্ন হইয়াছিল। অসরকারি সূত্র অনুসারে, সরকারি অনুশাসনের ফলে গত পাঁচ বৎসরে ভারতে ষোলো হাজার ঘণ্টা বন্ধ থাকিয়াছে ইন্টারনেট, ক্ষতির অঙ্ক প্রায় তিনশত কোটি মার্কিন ডলার।

তবে কিনা, বাক্‌স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রাণ, তাহার উপর আঘাতের ক্ষতি অপূরণীয়— কোনও টাকা বা ডলারের অঙ্কে তাহার পরিমাপ করা যায় না। নাগরিকের বক্তব্য প্রকাশের অন্যতম উপায় সমাজমাধ্যম, জনমত গড়িয়া উঠিবার মঞ্চও বটে। স্বভাবতই প্রশাসনের প্রবণতাই হইল তাহাকে যদৃচ্ছ নিয়ন্ত্রণ করা। ‘অশান্তি’ নিয়ন্ত্রণের অছিলায় বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা। তাই কার্ফু জারির মতোই, নেট বিচ্ছিন্নতাকে সতর্ক ভাবে, স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করিতে হইবে। প্রশাসনকে মনে রাখিতে হইবে, ইহা আপৎকালীন ব্যবস্থামাত্র, শান্তিরক্ষার পদ্ধতি ইহা নয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE