এই করোনা-কালে সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুটাই মিডিয়ার কাছে সবচেয়ে বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। অথচ এ দেশে একের পর এক কত বিপর্যয়। আমপান ছিন্নভিন্ন করে দিল গোটা পশ্চিমবঙ্গকে, ন্যাশনাল মিডিয়ায় তার প্রায় কোনও কভারেজই হল না। অথচ হাজার গুণ বেশি তৎপরতা তরুণ এই অভিনেতার দুঃখজনক অকালমৃত্যুর কভারেজ নিয়ে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে কত রকমের নিবন্ধ যে বেরলো, আর সে সব পড়ে যে কত কিছু জানতে পারলাম সুশান্ত সিংহ সম্পর্কে! এত কিছু তাঁর জীবৎকালেও জানতে পারিনি। মনে আছে, কাই পো চে (২০১৩)-তে তাঁর প্রথম অভিনয় আমায় মুগ্ধ করেছিল, পুরস্কৃতও হয়েছিলেন সে জন্যে, সে ছবির প্রেক্ষাপটে ছিল গুজরাত দাঙ্গার সন্ত্রাস।
তবে কাই পো চে-র অভিনয়ের জন্য যতটা আলোচিত তাঁর হওয়া উচিত ছিল, ততটা তিনি হননি। এমনকি এম এস ধোনি: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি-তেও তাঁর অভিনয় নিয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। অথচ ভারতীয় ক্রিকেটের প্রাক্তন অধিনায়ককে নিয়ে তৈরি এই অনবদ্য ছবিতে কী চমৎকার অভিনয়ই না তিনি করেছিলেন। এ ছাড়াও মনে পড়ে বালাজি টেলিফিল্মস-এর সোপ-অপেরা পবিত্র রিস্তা (২০০৯-২০১৪), নায়কের চরিত্রে ছিলেন সুশান্ত। পাঠকের মনে থাকতে পারে, দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই সিরিয়ালটির কথা, শেষ হয়েছিল মানব আর অর্চনার মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর স্বর্গে তাদের পুনর্মিলনে। সুশান্ত আর অঙ্কিতা লোখান্ডে করেছিলেন ওই চরিত্র দু’টি। সুশান্তের জীবনে অঙ্কিতা সেই সময়ের সঙ্গী ছিলেন বলে অভিযোগের আঙুল আজ তাঁর দিকেও উঠছে।
এখন অবশ্য সুশান্তকে ফিল্ম আর টেলিভিশনের তারকা হিসেবে মনে রাখাটাই ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। তাঁর অকালমৃত্যু হঠাৎ যেন তাঁকে আমাদের কাছে মূর্তিমান ‘তামাশা’ করে তুলেছে। ভারতীয় মিডিয়ায় কেবলই তাঁর মানসিক বিপর্যয়ের কথা আলোচনা চলছে, রোগীর ব্যক্তিগত পরিসর বা ‘প্রাইভেসি’— সে সব পাত্তাও না দিয়ে। এমন ভাবে তাঁকে উপস্থাপিত করা হচ্ছে, যেন তাঁর ইচ্ছাশক্তি বলে কোনও বস্তুই ছিল না, যেন তিনি এতই দুর্বলচিত্ত, মাদকাসক্ত ছিলেন যে বান্ধবীর বশীভূত হয়েই থাকতেন। আমরা শুনছি, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বান্ধবী রিয়া নাকি সুশান্তকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিলেন সুশান্তের বাবা-মা, পরিবারের থেকে, সুশান্তও তা বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছিলেন।
এ দিকে সুশান্তের মৃত্যুর পর ভারতীয় সিনেমার এক প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী ঘোষণা করে বসলেন যে, মুম্বই শহরটা বহিরাগতদের জন্য নিরাপদ নয়। শুনেই কেন্দ্রীয় সরকার সেই অভিনেত্রীকে ‘ওয়াই’ ক্যাটেগরির নিরাপত্তা দিয়ে দিল! ও দিকে খেপে গিেয় সেই অভিনেত্রীর অফিসের ‘অবৈধ’ নির্মাণ ভেঙে দিল বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। আপাতত শরদ পওয়ার আর উদ্ধব ঠাকরের স্বার্থান্ধ দলাদলির সংঘর্ষবিন্দু অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত।
এর মধ্যে সুশান্তের পরিবার লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে। রিয়া, মুম্বইয়ের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনেত্রী, মাদকদ্রব্যের অবৈধ কারবারি বলে অভিযুক্ত হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে চোর বলেও প্রমাণের েচষ্টা চলছে। অভিযোগ: সুশান্তের সঞ্চিত অর্থের তছরুপ করেছেন তিনি, ১৫ কোটি টাকা সরিয়ে তা দিয়ে বেআইনি কাজে লাগিয়েছেন। অতি জাহাঁবাজ মহিলা তিনি, ‘পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক’ লেখা জামা পরে গ্রেফতার বরণ করেন! বলিউডের বহু অভিনেতাই অবশ্য টুইট করে তাঁর এই সাহসী স্লোগানের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, কিছু দিন আগে টেলিভিশনের একটি চ্যানেলে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘মি-টু’র অভিযোগ উঠেছিল সুশান্তের বিরুদ্ধে, তাতে সুশান্ত ভয় পেয়ে ভেবেছিলেন, যে সব চরিত্রে তাঁর অভিনয় করার কথা, সেগুলি হয়তো হাতছাড়া হয়ে যাবে!
অনেকেই একটা ন্যায্য প্রশ্ন তুলছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক সংস্থা কেন রিয়া আর তাঁর পরিবারের পিছনে এ ভাবে লেগে রয়েছে? ইডি, সিবিআই এবং নার্কোটিক বুরো— রিয়ার মতো এক সাধারণ অভিনেত্রীকে নিয়ে তদন্তের জন্যে কি এতগুলি গোয়েন্দা সংস্থার কোনও দরকার ছিল? যেখানে অভিযোগ মাত্র ৫৯ গ্রাম গাঁজা নিয়ে? ভাবতেই হচ্ছে যে, আসলে এর পিছনে চলছে রাজনৈতিক সার্কাস— যেটা সাধারণ চোখে দেখা যাচ্ছে না। বিহারের নির্বাচন এসে গেল প্রায়, আর তাই জন্যই মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তাঁর রাজ্যের পুলিশবাহিনীর হাতে তুলে দিতে চাইছিলেন বিহারের ভূমিপুত্র সুশান্তের মৃত্যু-তদন্তের ভার।
শোনা যাচ্ছে স্বজনপোষণ আর উচ্চবর্গের জীবনযাপনের বিষয়টিও। তবে কি রিয়া চক্রবর্তীকে গ্রেফতার আসলে বলিউডকে শোধরানোরই চেষ্টা? না কি এ সব হচ্ছে বলিউডের সেই সব অভিনেতাকে শায়েস্তা করার জন্য, যাঁরা মাদক ও যৌন আসক্তির বিলাসবহুলতায় ঈর্ষণীয় গতিময় জীবন যাপন করে থাকেন? হিন্দুত্ব, নব্য উদারতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র সব কি একসঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে? বলিউডের মতো একটা ইন্ডাস্ট্রি, যেখানে এখনও নানা মত ও পথের মিলন ঘটে, তাকে মজা দেখানোর জন্যই এত কিছু?
না কি, এই কোভিড-ঋতুতে মানুষের মন অন্য দিকে ঘোরানোর জন্যই এমন এক হিংস্রতায় ঘটনাটা পেশ করা হল টেলিভিশনের পর্দায়, ভারতীয় মিডিয়া তার বর্বরতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল? কিছু চ্যানেল তো এতই নীচে নামল যে, সুশান্তের মৃতদেহকে যেন বার বার টিভির স্ক্রিনে লেপ্টে দিল তারা, কিছুমাত্র সংবেদনশীলতা ছাড়াই। আবার কিছু চ্যানেলের ক্যামেরা রিয়াকে তাঁর বাড়ি থেকে পুলিশ থানা পর্যন্ত প্রতি মুহূর্ত ঘিরে রাখল।
বলিউডও কি নিজের জায়গা খুঁজে ফিরল ভারতীয় রাজনীতি নামক দাবাখেলায়? নয়তো রিয়াই বা কেন সুশান্তের জন্য ন্যায়বিচার চাইতে টুইট করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে? মন্ত্রিমশাই রিয়ার ফোনকে গুরুত্বই দিলেন না মোটে, অথচ অন্য এক অভিনেত্রীকে ওয়াই ক্যাটেগরির নিরাপত্তা (যা কিনা অর্ণব গোস্বামীর মতো ‘সেলেব্রিটি’রা পান) দিতে মহা উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
শিউরে উঠতে হয় রিয়া আর তাঁর পরিবারের উপর লাগাতার ‘কভারেজ’ দেখে। কী সাংঘাতিক ডাইনি শিকারের চেষ্টা! রিয়া ভারতীয় পারিবারিক মূল্যবোধে ‘আঘাত’ হেনেছেন, অতএব শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে! আগেকার দিনে ডাইনিকে পুড়িয়ে মারা হত। এখন রিয়াকে গ্রেফতার করে জামিনহীন জেলজীবন দেওয়া হচ্ছে। েয করে হোক, ‘পাপী’কে তার ‘পাপ-জীবন’-এর জন্য চরম মূল্য দিতেই হবে। একটি মৃত্যু কোথায় এনে ফেলল দেশকে?
যে ভাবে একটি দুঃখজনক ঘটনাকে দর্শকদের কাছে সস্তা ডাইনি-গল্পের বিনোদন করে তুলল আমাদের মিডিয়া, ইতিমধ্যে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রযোজকদের গিল্ড তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। হয়তো যে নতুন প্রজন্ম এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিতে চায়, তাদের কাছে বলিউড একটা আশ্বাস পৌঁছতে চাইছে যে— তার হাজারো অসম্পূর্ণতা বা দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতীয় মিডিয়ার মতো সে নষ্ট ও সস্তা হয়ে যায়নি।
আমরা হয়তো কোনও দিন জানতেও পারব না, কেন সুশান্ত তাঁর জীবন শেষ করে দিলেন। দীপিকা পাড়ুকোন ও অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সাম্প্রতিক কালে মন-শুশ্রূষার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার ফাউন্ডেশন তৈরি করেছেন। প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে সুশান্তের মৃত্যু কিন্তু আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেল, ভারতীয় মিডিয়া জগতে এই সব প্রচেষ্টা দাঁতও ফোটাতে পারেনি। করোনা-যুগের টিআরপি-অধ্যুষিত পরিবেশে আর সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল এই ট্র্যাজেডি, যেখানে এক তরুণী তাঁর থেকে অনেক বেশি বিখ্যাত চিত্রতারকার সঙ্গে একত্রবাস করতেন। অন্যরা যেখানে কষ্টের জীবন বাঁচছেন, সেখানে রিয়া পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে ইউরোপে যাচ্ছেন, দামি দামি জামাকাপড় পরছেন। বোঝাই যায়, কেন তিনি আজ ভারী সুবিধেজনক ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’— যত ইচ্ছে ঘুসি-কিল মারার মতো।
করোনা সংক্রমণের প্রথম পর্বে দেখেছিলাম, স্বাস্থ্যসঙ্কট ও জাতীয় নিরাপত্তার কথা তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল শাহিনবাগের মহিলাদের। ছয় মাস পর দেখলাম, এক সুন্দরী মহিলাকে জেলবন্দি করা হল পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংসের অভিযোগে, ‘শুদ্ধ সংযমী’ নেশন গড়ার নামে। এর পর? এর পর কে? আগামী কোন মিডিয়া সার্কাসের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা? এই আমরা— বিপুল জনসংখ্যা, মরা অর্থনীতি, চাকরিবাকরির অভাব, কোথাও বেরনোর উপায় নেই— যাদের একটাই কাজ এখন, বাড়িতে বসে টিভির এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে যাওয়া শুধু...
সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশনস, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়, শিকাগো ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy