ছবি: সংগৃহীত
সুনীতা রানে নামটা তত পরিচিত নয়। তবে এই অপরিচিতি সম্ভবত বেশি দিন থাকবে না। এক বিশাল সংগঠনের মুখপাত্র সুনীতা রানে, সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৫০০০। মুখ্য কার্যালয় দিল্লি। গত বছর রাজধানীর বুকে তাঁদের ধর্না সারা দেশের ইতিহাসে প্রথম। এই সংগঠন ডোমেস্টিক ওয়ার্কার বা গৃহকর্মে সহায়িকা দিদিদের। তাঁদের, যাঁদের ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না। এই উৎসবের মরসুম শেষ হওয়ার আগের মুহূর্তে ডিজিটাল মিডিয়ার কাছে রীতিমতো জোরালো ভাবে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছেন সুনীতা।
‘‘দেওয়ালির শেষে ফ্রিজে রাখা বাসি মিষ্টি দিয়েই কর্তব্য শেষ করেন আমাদের মালিকরা। নতুন জামাকাপড় কখনও দেন, কখনও আবার বাড়িতে থাকা পুরনো কাপড়ই গছিয়ে দেন। মাত্র ১% মালিকরা দেন নতুন শাড়ি। বকশিশও তা-ই, তাঁদের ইচ্ছেমতো।” উচ্ছিষ্ট নয়, অধিকার চাই— পরিষ্কার বক্তব্য সুনীতা আর ন্যাশনাল ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের। ‘‘বোনাস দিতে হবে। উৎসবের প্রাপ্য ছুটি দিতে হবে।’’
‘‘দেওয়ালির আগে মালিকের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হয় জানপ্রাণ লাগিয়ে। আমাদের বাড়িঘর কিন্তু নোংরাই থেকে যায়— কারণ বাড়ি ফিরে আর শক্তি থাকে না। দেওয়ালির দিন বাড়িভর্তি অতিথি আসেন মালিকের বাড়িতে, আমরা তাঁদের বাসন পরিষ্কার করি। আমাদের বাড়ির লোক পথ চেয়ে বসে থাকে। রাতে হাক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি, হাতে থাকে একটা একশো টাকার নোট, যা উৎসবের দিনে দয়া করে আমাদের বকশিশ দেওয়া হয়েছে।’’
“বকশিশ দেওয়ার নামে দয়া চাই না। নির্দিষ্ট পাওনা চাই।’’ এক মাসের মাইনের বোনাস সম্পর্কে অনড় সুনীতারা। আর বকশিশও সব সহায়িকাদের জন্য নির্দিষ্ট বেঁধে দেওয়া হবে, যা মালিকদের মানতেই হবে। উৎসবের দিনে কাজ করালে তার প্রাপ্য দিতে হবে। ‘‘অসুস্থ হয়ে ছুটি নিলেও বার বার ফোন করতে থাকেন বাড়ির বৌদিরা।” নির্দিষ্ট ছুটি, কাজ ছাড়ানোর আগে নোটিস, সর্বনিম্ন মজুরি, মাতৃত্বকালীন ছুটি— এগুলো তাঁদের অধিকার। শ্রমের অধিকার, বিশ্রামেরও অধিকার।
গৃহকর্মে সহায়িকাদের শ্রমের নির্দিষ্ট মজুরি, নির্দিষ্ট সময়, সম্মান ইত্যাদি তো দূরের কথা, তাঁদের বিশ্রামের সময়ের উপরেও অধিকার নেই। এ তো দাসত্বেরই নামান্তর। এমনটাই মনে হয়েছিল আশির দশকে ডা. জিয়েনে দেভোসের। বেলজিয়াম থেকে মুম্বইতে এসে লক্ষ করেন, গৃহকর্মে সহায়িকাদের ক্ষেত্রটা মূলত মহিলা, শিশু-অধ্যুষিত। একে তো অসংগঠিত শ্রমের জায়গা, তার উপর মহিলা বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে প্রতিবাদ করা আরও কঠিন। আইনি প্রেক্ষাপটও তখন ছিল দুর্বল। এখনও মাত্র দু’টি আইন গৃহকর্মকে শ্রমের মান্যতা দেয়— সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অব উইমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস (প্রিভেনশন, প্রহিবিশন অ্যান্ড রিড্রেসাল) অ্যাক্ট, ২০১৩ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দেভোসের সময়ে ছিল না এই আইনও। এক জন ১৩ বছরের সহায়িকার ধর্ষণ এবং মৃত্যুর কথা জানার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এক আন্দোলন গড়ে তোলার।
ডা. দেভোসের নেতৃত্বেই প্রথম গড়ে ওঠে ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স মুভমেন্ট। মূল লক্ষ্য ছিল, শ্রমের সম্মান, সহায়িকাদের শ্রমিকের স্বীকৃত অধিকারগুলো দেওয়া এবং যে কোনও অত্যাচার থেকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া। বম্বে পাবলিক ট্রাস্ট অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর নিয়মে ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি পায় ন্যাশনাল ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স মুভমেন্ট, যার মুখ্য কার্যালয় মুম্বইতে। এখন তাদের সদস্যসংখ্যা ২০০০০০। মুখপাত্র অমলা ভালারমাথি। আপ্রাণ লড়েছেন তাঁরা, সহায়িকাদের শ্রমের সম্মানের জন্য।
আমাদের রাজ্যের সহায়িকা সংগঠনের নাম পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতি, তাদের মুখপাত্র বিভা নস্কর। সংগঠিত আন্দোলনের দিক থেকে একটু পরেই শুরু হয়েছে এই সমিতির পথচলা। ২০০৫ সালে গঠিত, মাত্র এক বছর আগে ট্রেড ইউনিয়নের মর্যাদা পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের এই সহায়িকা সংগঠন।
ইদানীং এই আন্দোলন আরও গুরুত্ব পায়। কারণ পরিচারিকাদের উপর অত্যাচারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নারী ও শিশু পাচারের মাত্রাও। ২০১৭ সালের মে মাসে দিল্লিতে ঝাড়খণ্ডের সোনিকা কুমারীর মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সোনিকা নাবালিকা এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত, এবং পাচারচক্রের শিকার হয়ে দিল্লিতে পরিচারিকা হিসেবে স্থান পায়। নিজের প্রাপ্য মজুরি চাওয়ায় খুন করা হয় তাকে, এমনটাই জানা যায় পুলিশসূত্রে। এই ঘটনার পর দেশের সমস্ত ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইউনিয়নই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সহায়িকাদের শ্রমের সম্মান দেওয়ার দাবি জানায়। ২০১১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশন ১৮০ গৃহ পরিচারিকাদের দেয় শ্রমের সম্মান ও শ্রমিকের অধিকার। এখনও অবধি ২১টি দেশ এই কনভেনশন মেনে নিলেও, ভারত মেনে নেয়নি। তাই ভারতে প্রায় ১৬ লক্ষেরও বেশি সহায়িকাদের নেই কোনও আইনি সুরক্ষা।
তাঁদের এই আন্দোলন আজ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, শিক্ষাবিদদেরও। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রাজেশ জোসেফ, রোশনি লোবো এবং বালমুরলী নটরাজনের নিবন্ধ ‘বিটুইন বকশিশ অ্যান্ড বোনাস— প্রিকারিটি, ক্লাস অ্যান্ড কালেক্টিভ অ্যাকশন অ্যামং ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন বেঙ্গালুরু’ তার প্রমাণ। যেমন প্রমাণ আর একটি বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত রুপা দেহিজিয়ার ‘দ্য ইকনমিক থিয়োরি বিহাইন্ড দিওয়ালি বকশিশ’ নিবন্ধটিও।
দুর্গাপুজো, ইদ, দেওয়ালি হয়ে ক্রিসমাস। এই উৎসবের মরসুমে নিজেদের হয়ে সেই কণ্ঠস্বরকে এক করেছেন তাঁরা। চোখের সামনে গৃহকর্তাদের অসংখ্য অপচয়ের কাজ করতে দেখেন তাঁরা, আবার সামান্য বকশিশ দিতে প্রবল কার্পণ্যও তাঁদের চোখ এড়ায় না।
হয়তো দয়া, অনুগ্রহ, আধখাওয়া মিষ্টির প্যাকেটের দিন ফুরাতে চলেছে। উৎসবের মরসুমে পাওনাগন্ডা বুঝে নিতে তৈরি সুনীতা, রুমা, বিভারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy