—ফাইল চিত্র
‘আয়লা’ বা ‘বুলবুল’-এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করতে গিয়ে বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে সুন্দরবনের কথা। অনেকেই বলেছিলেন, প্রাকৃতিক দেওয়াল হিসেবে সুন্দরবন অনেকটাই রক্ষা করেছে ভূ-ভাগকে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ‘আমপান’-এর পরে দেখা গেল, ঝড়ের দাপট রুখতে সুন্দরবন কিছুটা হলেও ব্যর্থ। এর কারণ হিসেবে আমপানের আকার ও তার ধ্বংসক্ষমতার বিপুলতাকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়েছে।
তবে গবেষকদের দাবি, এর সঙ্গে সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থাও আলোচনায় আসা উচিত। বাঘের সংখ্যা কমা, অরণ্য সম্পদের উপরে অত্যধিক নির্ভরশীলতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আবহাওয়া পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বিষয়গুলি তো রয়েছেই। আসলে শুধু সুন্দরবন নয়, সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র এক সঙ্কটের সামনে।
উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রে একই সঙ্গে স্থল ও জলের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ এখানকার বাস্তুতন্ত্রে স্থলজ ও জলজ, উভয় প্রকার জীবই বর্তমান। এর সুস্থিতির উপরে সমুদ্র থেকে দূরবর্তী স্থলভাগ ও গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের সুস্থিতি অনেকটা নির্ভর করে। গবেষকদের মতে, উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রই সামুদ্রিক ও স্থলজ বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্রের অনেকাংশের ধারক ও বাহক। অথচ এই বাস্তুতন্ত্রই আবহাওয়া পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো ঘটনায় সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়ে চলেছে।
উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে জলজ জীবেরা। গবেষকদের মতে, উপকূলে সমুদ্রের গভীরতা কম এবং সেখানে জলের বেশ কিছুটা ভেতরে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে বলেই উপকূল হল জলজ জীববৈচিত্রের ‘হটস্পট’। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, জলতলের উচ্চতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সমুদ্র উপকূলে জলজ জীবদের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এর জেরে প্রভাব পড়ছে গভীর সমুদ্রের খাদ্যশৃঙ্খলেও।
স্থলভাগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটা একমাত্রিক নয়। সমুদ্র উপকূলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বহু বিখ্যাত শহর ও পর্যটনকেন্দ্র। সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বাড়লে সেগুলি জলমগ্ন হয়ে পড়া ও বহু মানুষের বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা রয়েছে। আবার, বহু জায়গায় রয়েছে সুন্দরবনের মতো জীববৈচিত্রের নানা প্রাকৃতিক আধারও। গবেষকদের দাবি, সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি এদের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করাবে। তাতে বিপন্ন হবে জনজীবনও। গবেষকদের দাবি, স্থলজ বাস্তুতন্ত্রে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের পাশাপাশি, প্রশান্ত ও অতলান্তিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী বহু এলাকার বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। উত্তর আমেরিকার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এর ক্ষতিকর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়েও জল্পনা বাড়ছে।
সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি এক দিকে যেমন ‘আমপান’-এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা বাড়াবে, তেমনই জলতল বাড়লে উপকূলে সমুদ্রের ক্ষয়কার্যও বাড়বে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের। তাঁদের দাবি, উপকূল এলাকায় প্রাকৃতিক ক্ষয়কার্য বাড়লে তার ফল ভুগতে হবে স্থলভাগের বাসিন্দাদেরও। সবথেকে বড় বিষয়, সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি রাসায়নিক আবহবিকারকে ত্বরাণ্বিত করবে। ফলে শিলার গঠনেও পরিবর্তন আসবে।
এর সঙ্গে জলতলের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মৌসুমি বায়ুর মতো মরসুম অনুসারে দিক বদলকারী বায়ুপ্রবাহের চক্রে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কাও প্রবল।
গবেষকদের দাবি, উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রে আগামী দিনে কতটা বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে, তার একটা নমুনা দেখা গিয়েছে প্রবাল প্রাচীর ও নামিবিয়ার মরু উপকূলের পরিবর্তনে। সমুদ্রের জলের অম্লত্ব ও উষ্ণতা বৃদ্ধিতে এর মধ্যেই গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ-সহ একাধিক পথিবী বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর তার সম্পদ হারাতে বসেছে।
আবার, নামিবিয়া উপকূলে মরু এলাকার অত্যধিক উষ্ণতাবৃদ্ধি ও জলতলের উচ্চতাবৃদ্ধিতে সেখানকার বায়ুপ্রবাহের দিকবদল ও রাসায়নিক আবহবিকারে বড় ধরনের পরিবর্তনের আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, এই তাণ্ডবলীলা সুন্দরবনের মতো এলাকায় শুরু হলে সভ্যতাকে রক্ষা করা সত্যিই সঙ্কটের হয়ে দাঁড়াবে। এর জন্য ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ বলবৎ করা-সহ নানা পদক্ষেপ জরুরি বলেই অভিমত আবহবিদদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy